বিজয়ের ডিসেম্বর দেশে দেশে
কেনিয়া: মাউ মাউ বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার গর্জন
ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের মাস। কিন্তু বিশ্বে এমন আরও বহু দেশ আছে, যারা তাদের স্বাধীনতা, মুক্তি অথবা যুদ্ধের সমাপ্তির সাফল্যকে স্মরণ করে ‘বিজয় দিবস’ বা সমতুল্য নামে। প্রথম আলো ডিসেম্বরের এই বিশেষ আয়োজনে তুলে ধরছে কীভাবে তারা সেই দিনটিকে আজও নিজেদের জাতীয় জীবনে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আফ্রিকার দিগন্তজোড়া সাভানা আর বন্য প্রকৃতির দেশ কেনিয়া। কিন্তু এই শান্ত প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে আছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের এক উত্তপ্ত ইতিহাস। আজ ১২ ডিসেম্বর কেনিয়ার ‘জামহুরি দিবস’ (Jamhuri Day)। সোয়াহিলি ভাষায় ‘জামহুরি’ শব্দের অর্থ ‘প্রজাতন্ত্র’। এই দিনটি কেনিয়াবাসীর কাছে দ্বিগুণ আনন্দের—কারণ, ১৯৬৩ সালের এই দিনে তারা ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ঠিক এক বছর পর ১৯৬৪ সালের একই দিনে দেশটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
কেনিয়ার এই বিজয়ের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। ১৯৫০-এর দশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘মাউ মাউ বিদ্রোহ’ (Mau Mau Uprising) ছিল এই স্বাধীনতার মূল চালিকাশক্তি। জঙ্গল ও পাহাড়ের আড়াল থেকে সাধারণ কৃষকেরা ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে দা, কুড়াল আর পুরোনো বন্দুক নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশরা হাজার হাজার স্বাধীনতাকামীকে বন্দী করে, হত্যা করে ও নির্যাতন চালায়। কিন্তু মাউ মাউ যোদ্ধাদের সেই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাদের সেই রক্তস্রোতই শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের কেনিয়া ছাড়তে বাধ্য করে।
স্বাধীনতার পর দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট জোমো কেনিয়াট্টা ডাক দেন ‘হারাম্বি’ (Harambee) বা ‘একসঙ্গে কাজ করার’ দর্শনের। এটি কেবল একটি স্লোগান ছিল না, এটি ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে নতুন করে গড়ার মন্ত্র। আজকের দিনে নাইরোবিসহ পুরো কেনিয়া উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে। কুচকাওয়াজ, ঐতিহ্যবাহী নাচ আর ‘নয়ামা চোমা’ (রোস্ট করা মাংস) খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। কেনিয়ার পতাকার কালো রং তাদের জনগণকে, লাল রং তাদের ঝরানো রক্তকে, আর সবুজ রং তাদের উর্বর ভূমিকে নির্দেশ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে কেনিয়ার সংগ্রামের অদ্ভুত মিল রয়েছে। তারাও অস্ত্রের মুখে নিজেদের অধিকার ছাড়েনি, আমরাও ছাড়িনি। আমাদের ১৬ ডিসেম্বরের মতোই ১২ ডিসেম্বর কেনিয়ার মানুষের কাছে শৃঙ্খল ভাঙার এক মহাকাব্যিক দিন। দিনটি বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়—শোষক যতই শক্তিশালী হোক, জনতার ঐক্যের গর্জনের সামনে তারা শুধুই কাগজের বাঘ।