সুজনের আলোচনায় বক্তারা: সহিংসতা নয়, সমঝোতার পথ খোঁজাই সমাধান

অনলাইনে আজ রোববার ‘সমঝোতা নাকি সহিংসতা: কোন পথে আমরা?' শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে সুজন
ছবি: সংগৃহীত

নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মুখোমুখি অবস্থানে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। আলাপ-আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। দুই দলের অনড় অবস্থান দেশকে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সংলাপ-সমঝোতার পথ একেবারে রুদ্ধ হয়নি। জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দুই পক্ষের দ্রুত আলোচনার টেবিলে বসা প্রয়োজন।

আজ রোববার ‘সমঝোতা নাকি সহিংসতা: কোন পথে আমরা?’ শীর্ষক সভায় আলোচকেরা এসব কথা বলেন। অনলাইনে এই সভার আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

সূচনা বক্তব্যে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী আগামী ১ নভেম্বর ২০২৩ থেকে ২৯ জানুয়ারি ২০২৪-এর মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সবার চাওয়া এই নির্বাচন হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক। কিন্তু বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য অনুকূল না।

বদিউল আলম বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। যার পরিণতি হতে পারে জাতির জন্য চরম অমঙ্গলকর। নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে তৈরি হওয়া উত্তাপ-উত্তেজনা ভয়াবহ সহিংসতার দিকে ধাবিত করতে পারে। তাই আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানাই।’

সভায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন, তাঁরা ভাবছেন রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বেশি বেশি টাকাপয়সা কামানো যায়। উত্তরোত্তর ধনী হওয়ার প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁদের মিষ্টি কথায় সরানো যাবে না। নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট আছে, যেটার সমাধান দেখছি না। তবে বিশ্বাস করি, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। সময় কম থাকায় তাড়াহুড়ো আছে। সব না হলেও কিছুটা সমাধান করতে হবে।’

সংসদ সদস্যরা যা বললেন

আগামী কয়েক মাসে প্রচুর রক্তপাতের আশঙ্কা করছেন বলে জানান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা। আলাপ-আলোচনার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না বলেন তিনি। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজপথে দাবি আদায় করতে হবে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সুন্দর পরিবেশে আলোচনা হয়েছিল। কেমন নির্বাচন হয়েছে সবাই দেখেছে। তাই আলোচনার ওপর বিশ্বাসও থাকতে হবে।’
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তিনি বলেন, সব সমস্যার সমাধান এক বসাতে হয়ে যাবে না। প্রতি ৫ বছর পরপর নির্বাচন এলে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এককভাবে কোনো দলের পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না৷
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সবার আগে সমঝোতা চাই, এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আসতে হবে। আওয়ামী লীগের জন্য ২০১৪ সালে নির্বাচন করে ফেলাই সাফল্য ছিল। এবার ভোটের পরে মূল সমস্যা হবে, এটা সরকারকে বুঝতে হবে। বিদেশিরা গণতন্ত্রকে শুদ্ধ করে দিতে পারবে না৷ তবে তাদের সহায়তা ছাড়া বিরোধীদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিও তৈরি হতো না।

সমঝোতা এখন অলীক চিন্তা

সমঝোতার বিষয়টি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অলীক চিন্তাভাবনা বলে মনে করেন মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, সব পক্ষ ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জন্য বিভোর। তারা বিকল্প চিন্তা করতে পারে না। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আসলেই চিন্তিত। দেশ এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপির না, সুপার পাওয়ারগুলোর খেলার জায়গা।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক সংকট সমাধানে কী করতে হবে, সেগুলো নিয়ে অতীতেও আলোচনা হয়েছে। দুটি বড় রাজনৈতিক দলের ভোট প্রায় সমান সমান। সমাজের একটা বড় অংশকে বাদ দিয়ে দেশ এগোতে পারে না।

সমঝোতার ন্যূনতম যে শর্ত থাকে, বর্তমানে তা উপস্থিত নেই বলে মনে করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে যে পরিস্থিতির জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল, গত ২৭ বছরে যে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের লোকজন আরও বেশি দলীয়করণ হয়েছে৷ তিনি মনে করেন, আগামী ৩ মাসে সমাধান কঠিন। তবে রাজনৈতিক পক্ষগুলো একমত হলে অন্তর্বর্তীকালীন কোনো ব্যবস্থা হতে পারে।

ভোটার তালিকা নিয়ে গন্ডগোল হবে

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিলে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ভোটার তালিকা করতে হবে। এটি একটি সিরিয়াস ধারা। পুরোপুরি সংবিধান পরিপন্থী এটি নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে বড় রকমের গন্ডগোল হবে৷ তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ৯১(ক) ধারায় সংশোধনী এনে নির্বাচনের ওপর কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করা হয়েছে৷ মুখ দিয়ে বলবেন, ইসিকে শক্তিশালী করতে হবে৷ আর তার অঙ্গ কাটতে শুরু করলেন।

সভায় সভাপতিত্ব করেন সুজনের জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক সেকান্দার খান। তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে৷ সাধারণ মানুষকে নিয়ে তারা চিন্তা করছে না। সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সচেষ্ট হলে নির্বাচন নিয়ে তাদের ভয় থাকত না।

৩১ দফা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে

বিরোধী দলগুলোর চলমান আন্দোলনে গুণগত পরিবর্তন রয়েছে বলে জানান গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য ৩১ দফা ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে আলোচনা সম্ভব না৷ তবে সরকারের দিক থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া নেই৷ সরকার একগুঁয়েমি করলে আন্দোলন করেই অধিকার আদায় করতে হবে৷
তবে বিরোধী দলগুলোর ঘোষিত ৩১ দফা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, যাঁরা ৩১ দফা দিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে এই দফা তাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, এটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুবিধা নিয়ে ক্ষমতায় এসে সেই পদ্ধতি বাতিল করেছে৷  

সংকট নিরসনে জাতীয় সনদ  

সভায় সুজনের পক্ষ থেকে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১৭ দফার জাতীয় সনদের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়৷ সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার এটি পড়ে শোনান।

জাতীয় সনদে সম্ভাব্য ঐকমত্যের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন, কার্যকর জাতীয় সংসদ, স্বাধীন বিচার বিভাগ, সাংবিধানিক সংস্কার, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক দল, স্বাধীন বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান, প্রশাসনিক সংস্কার, বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংরক্ষণের মতো বিষয় রয়েছে৷

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই বিষয়গুলো প্রাথমিক বিষয় হিসেবে ধরে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে৷ ঐকমত্য সৃষ্টির মাধ্যমে ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন ও স্বাক্ষর করা সম্ভব হলে রাজনীতিতে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হবে। তবে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হবে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার।