‘২০২২ সালে বিশ্বে ২৩ লাখ নারীর স্তন ক্যানসার নির্ণীত হয়েছে। যার মধ্য প্রায় সাড়ে ছয় লাখ নারী মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশে এ সংখ্যাটা ১২ থেকে ১৩ হাজার, যার মধ্যে অর্ধেকই মৃত্যুবরণ করেছেন। উন্নত বিশ্বে দশজনে নয়জন সুস্থ হচ্ছেন, আমাদের দেশে সেটা দশজনে চার বা পাঁচজন। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশের রোগীরা আসেনই স্টেজ–থ্রি বা ফোরে। যেই রোগীদের অধিকাংশের বয়সই ৫০ বছরের নিচে।’ স্তন ক্যানসারের বর্তমান হারটা কেমন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলছিলেন স্কয়ার হসপিটালস লিমিটেডের অনকোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন। এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় অতিথি হয়ে কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, ডায়াগনোসিস এবং রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন। ৯ অক্টোবর পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ক্যানসার নিয়ে বর্তমান ধারণা ও ইতিহাস তুলে ধরেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন। তিনি বলেন, ‘ক্যানসারকে অনেকে ‘‘মডার্ন ডে ডিজিজ’’ বলে মনে করেন; কিন্তু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে স্তন ক্যানসার নিয়ে অবগত। বলা হয়ে থাকে, স্তন ক্যানসার প্রথম শনাক্ত করা হয় মিসরে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সালের দিকে। এ ক্যানসার নিয়ে বেশি গবেষণার ফলেই এর চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে ৪০-৪৯ বছর বয়সী প্রতি ছয়জন নারীর মধ্যে একজনের স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’
স্তন ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘স্তনে ব্যথাহীন গোটা পাওয়া, স্তনের বোঁটা দেবে যাওয়া, বোঁটা থেকে তরল কিছু নির্গত হওয়া, স্তনে ক্ষত পাওয়া ইত্যাদি। তাই এসব লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’
স্ক্রিনিং কী? সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশনটা কখন থেকে শুরু করতে হয়? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন জানান, ‘স্ক্রিনিং ও সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন ১৬ বছর বয়স থেকেই শুরু করা উচিত। এর উপযুক্ত সময় হলো, মাসিক বন্ধ হওয়ার সাত দিন পর। আর যাঁদের মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁরা প্রতি মাসের যেকোনো একটি দিন সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশনটা করবেন। দুটিই স্তন ক্যানসারকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণে বেশ কার্যকর।’
উপস্থাপক জানতে চান, মেমোগ্রাম কী এবং এটি কখন করাতে হয়? অধ্যাপক মো. মোয়াররফ হোসেন বলেন, ‘বিদেশে এটা ৪০ বছর পার হওয়ার পর বছরে একবার করে থাকে; কিন্তু বাংলাদেশে ৩৫ বছরের পরই করা উচিত।’
ক্যানসার মানেই কি মৃত্যু?—উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘মোটেই না। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত করে গেলে ৯০ ভাগ রোগীই সুস্থ হতে পারেন।’ স্তন ক্যানসার থেকে সুস্থতা পেতে এবং কেমোথেরাপি চলাকালে খাদ্যাভ্যাস কোনো গুরুত্ব বহন করে কি না? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘অবশ্যই খাদ্যাভ্যাসটা গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য সুষম, পুষ্টিকর এবং যে খাবার খেলে শরীরে শক্তি সঞ্চার হয়, সেগুলো খেতে হবে। কারণ, এগুলো ক্যানসার প্রতিরোধে বেশ কার্যকর।’
উপস্থাপক জানতে চান, ক্যানসার কি ছোঁয়াচে? উত্তরে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘না। এটি ডিএনএর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে। তাই একজনের ক্যানসার হলে তাঁর থেকে অন্যজনেরও হবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।’
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘চিকিৎসাপদ্ধতি সারা বিশ্বে একই। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চিকিৎসা করে থাকি। স্তন ক্যানসার চিকিৎসার চারটি মডালিটি বা পদ্ধতি রয়েছে—অপারেশন বা সার্জারি, ওষুধ, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও হরমোন থেরাপি। এমনকি ‘‘থ্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার’’-এর চিকিৎসাও আমরা দিয়ে থাকি। সুতরাং দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত।’
আলোচনার এ পর্যায়ে উপস্থাপক জানতে চান, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্যানসারের স্টেজটা কোনো ভূমিকা রাখে কি না? জবাবে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘তা তো অবশ্যই। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত হলে আমরা সার্জারি করে ফেলি। যদি স্টেজ–থ্রি বা ফোরে চলে যায়, অথবা ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার হয়, তাহলে কেমোথেরাপি দরকার। যদি সারা শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে রোগীকে অনেক দিন বেঁচে থাকার জন্য চিকিৎসা দিয়ে থাকি। সুতরাং রোগের পর্যায় অনুসারেই চিকিৎসাব্যবস্থা ঠিক করা হয়।’
পুরুষদের স্তন ক্যানসার কেন হয়? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘নারীদের যে কারণে হয়, পুরুষদেরও সেই কারণেই হয়। তাই উভয়ের ক্ষেত্রেই চিকিৎসাব্যবস্থা একই রকম।’
স্তন ক্যানসারে বয়সের সীমা কি ২০ বা ৪০-এর ওপরেই হবে, নাকি এর নিচেও হতে পারে? উত্তরে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘অবশ্যই হতে পারে। আমি এমন কিছু রোগী পেয়েছিও। এ ছাড়া বর্তমানে ৫০ বছর বয়সের নিচে রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে।’
ক্যানসার নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার বা প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘এ কুসংস্কারগুলো বেশি দেখা যায় নারীদের ক্ষেত্রে। লজ্জায় তাঁরা বলতে চান না। এখানে বাবা, স্বামী ও ভাইদের ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলে সবাই মিলে এ ধরনের কুসংস্কার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা যাবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ‘গ্লোবাল ব্রেস্ট ক্যানসার ইনিশিয়েটিভ’ সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘এ স্ট্র্যাটেজিটা কোভিড চলাকালে নেওয়া হয়েছিল। এ পরিকল্পনা অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে কিছু লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে—প্রথমত, যে দেশগুলোতে প্রতি ১০ জনে ৬ জনই মৃত্যুবরণ করছেন, সেখানে প্রতিবছর মৃত্যুর হারটা ২ শতাংশে কমিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, রোগীদের ৬০ শতাংশের যেন প্রাথমিক পর্যায়েই স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয়। তৃতীয়ত, রোগনির্ণয়ের দুই মাসের মধ্যেই চিকিৎসা শুরু করা এবং ৮০ ভাগ রোগীকেই চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা। এ তিনটি স্তম্ভের ওপরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেশগুলোকে স্তন ক্যানসার মোকাবিলায় সহযোগিতা করে আসছে।’
বাংলাদেশেই বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা হয়ে থাকে। তাহলে কি কোনো রোগীর বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘আমি মনে করি, কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, রোগী ক্যানসারের যে পর্যায়েই থাকুন না কেন, দেশেই সম্পূর্ণ চিকিৎসা ও ওষুধ রয়েছে। যার মাধ্যমে রোগী পরিপূর্ণ সুস্থ হতে পারবেন। সুতরাং ক্যানসার চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।’