আদালতে মামলা প্রমাণের ‘দায়’ কার?

প্রতীকী ছবি

কোনো মামলা করা হলে তার বিষয়বস্তু সাক্ষ্য দ্বারা আদালতে প্রমাণ করতে হয়। পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ না পেলে মামলাটি আদালত কর্তৃক খারিজ হয়ে যায়, এটিই আইনের বিধান। কাজেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে শুধু আদালতের শরণাপন্ন হওয়াই যথেষ্ট নয়, যথাযথ সাক্ষ্যও সেখানে পেশ করতে হয়।

মামলা প্রমাণের ‘দায়’ কার?

সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১০১ ধারা অনুযায়ী, মামলা প্রমাণ করার দায়িত্ব সর্বদা বাদীপক্ষের ওপর থাকবে। এর মানে হলো, যিনি আদালতকে কোনো বিষয়ের সত্যতা আছে বলে বিশ্বাস করাতে চান, তিনিই তা প্রমাণ করবেন। সুতরাং বিবাদীর প্রতি আনা অভিযোগ বাদীকেই প্রমাণ করতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, মামলা চলাকালে অভিযুক্ত ব্যক্তির নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না। আইনে বলা আছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে গণ্য হবেন। তাই মামলার শুরুতে আসামি বা অভিযুক্ত ব্যক্তির নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই। মামলা প্রতিষ্ঠা করার সম্পূর্ণ ভার বাদীপক্ষের ওপর বর্তায়। তবে বাদী যদি মামলা প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে সক্ষম হন, তখন বাদীর দেওয়া তথ্য-প্রমাণ খণ্ডনের জন্য বিবাদীকে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে হবে।

প্রতীকী ছবি

সাক্ষ্য আইনের ১০২ ধারার বিধান অনুযায়ী, মামলা যখন এমন পর্যায়ে থাকে যে কোনো পক্ষ সাক্ষ্য উপস্থাপন না করলে সেই পক্ষ পরাজিত হবে, তখন যে পক্ষের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাকে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে হবে। ফৌজদারি মামলায় বাদী প্রমাণ দাখিল করা সত্ত্বেও আসামি যদি প্রতিষ্ঠা করতে চান যে অপরাধ সংঘটনের সময় তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না; বরং অন্য কোথাও ছিলেন, তখন তাঁকেই সেটা প্রমাণ করতে হবে। তা না হলে মামলা বাদীর পক্ষে চলে যাবে। হাসমত আলী বনাম রাষ্ট্র ৫৩বিএলডি(এইচসি)১৬৮ মামলায় স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য তাঁর স্বামীকে আসামি করা হয়। এখানে আদালত অভিমত প্রকাশ করেন, স্ত্রীর মৃত্যুকালে আসামি যে বাড়িতে ছিলেন না, তা আসামিকে প্রমাণ করতে হবে। এভাবেই প্রমাণ দাখিলের ভার এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষে পরিবর্তন হয়।

সুতরাং, মামলা প্রমাণের দায় প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু বাদীর এবং তা অপরিবর্তনীয়। কিন্তু প্রমাণ দাখিলের দায়িত্ব মামলার অবস্থাভেদে পরিবর্তন হয়ে থাকে।

প্রতীকী ছবি

মামলার উদাহরণ

এক ব্যক্তি খুন হওয়ার পর তাঁর চাচা কর্তৃক দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে মামলাটি করা হয়। মামলার ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তি সন্ধ্যায় তাঁর চাচার বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পথে মামলার আসামিসহ কয়েকজন একত্রিত হয়ে ওই ব্যক্তির রাস্তা আটকে তাঁকে আপত্তিকর কথাবার্তা বলেন। এর ফলে ওই ব্যক্তি আকস্মিক উত্তেজিত হয়ে তাঁদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তাঁরা ওই ব্যক্তিকে টেনে আসামির বাড়িতে নিয়ে যান এবং আসামি তাঁকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। সেখানকার স্থানীয় ব্যক্তিরা ঘটনা টের পেয়ে আসামিকে জোরপূর্বক মৃত ব্যক্তির চাচার বাড়িতে নিয়ে গেলে তাঁর চাচা আসামিকে পুলিশে সোপর্দ করেন।

মামলার রায়ে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হলে আসামি সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিলে সাজা কমানোর উদ্দেশ্যে আইনের বেশ কিছু বিষয় উত্থাপন করা হয়। তার মধ্যে একটি ছিল যে আসামি আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করে মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন কি না। সে ক্ষেত্রে আসামি আত্মরক্ষা-সম্পর্কিত কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। ফলে সাজা বহাল রেখে আপিলটি খারিজ হয়।

শেষ কথা

মামলার শুরুতে বাদীকে মামলা প্রমাণ করার জন্য সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে হয়; অর্থাৎ মামলা প্রমাণের ভার বাদীর ওপর বর্তায়। বাদী সেটা করতে সক্ষম হলে বিবাদীকে তা খণ্ডন করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখাতে হয়। মূল কথা হলো, একটি মামলা চলাকালে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকলে যে পক্ষ পরাজিত হবে, সেই পক্ষকেই প্রমাণ দাখিল করতে হবে।

নাজিয়া আমিন আইনজীবী