হুদার পথেই আউয়াল কমিশন

সংলাপে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন সরকারে কোনো না কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছিল।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নিজেদের কর্মপরিকল্পনায় ১৪টি চ্যালেঞ্জ বা বাধা চিহ্নিত করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সেসব বাধা উত্তরণে কিছু উপায়ের কথাও তারা বলেছিল। এর প্রথমটি ছিল, ‘বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী যে সুপারিশগুলো অধিকাংশজন করেছেন, তা বাস্তবায়ন।’ কিন্তু বাস্তবে সংলাপে আসা সুপারিশ বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই ইসির।

দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করেছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। সে উদ্যোগের এক বছর হতে চলেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র ১০ মাস। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান নির্বাচন কমশিনও কি সংলাপ প্রশ্নে সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার দেখানো পথেই হাঁটছে?

মনে হচ্ছে, কী করবে তা আগেই ঠিক করে রেখেছে ইসি এবং সরকারের অঘোষিত দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তারা কাজ করবে।
মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার, অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নূরুল হুদা কমিশনও রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করেছিল। সংলাপে পাওয়া সুপারিশগুলোর কোনোটি রাজনৈতিক, কোনোটিকে সাংবিধানিক এবং কোনোটিকে নিজেদের এখতিয়ারভুক্ত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছিল হুদা কমিশন। এই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ–বিদেশে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে, গত নির্বাচনে দিনের ভোট ‘রাতে’ হয়ে গেছে।

গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নিয়ে ১৩ মার্চ থেকে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করে বর্তমান কমিশন। পর্যায়ক্রমে দেশের শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। অবশ্য বিএনপিসহ ৯টি রাজনৈতিক দল সংলাপ বর্জন করে। গত বছরের ৩১ জুলাই সংলাপ শেষ হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে আসা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে ১০টি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে ইসি। পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর আর তেমন কোনো তৎপরতা নেই।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

যেসব বিষয়ে ইসি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনা, ইভিএমের ব্যবহার, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, রাজনৈতিক মামলা, ইসির ক্ষমতা প্রয়োগ। ইসি বলেছিল, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

নির্বাচনের সময় কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে ইসির অধীনে ন্যস্ত করার বিষয়টিও সংবিধানের আলোকে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। ইভিএমের পক্ষে–বিপক্ষে মত এসেছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে পরে ইসি সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ইসি দাবি করেছিল, বেশির ভাগ দল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সরাসরি ইভিএমের পক্ষে অবস্থান ছিল মাত্র চারটি দলের।

গত বছরের ১৩ মার্চ ছিল ইসির সংলাপে অংশ নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আসলে ওই সংলাপ ছিল লোকদেখানো উদ্যোগ। কারণ, সংলাপে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ এসেছিল, তা একেবারেই আমলে নেয়নি ইসি। রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের বেশির ভাগ ইভিএম ব্যবহার না করতে বলেছিল। কিন্তু ইসি এককভাবে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিল। মনে হচ্ছে কী করবে তা আগেই ঠিক করে রেখেছে ইসি এবং সরকারের অঘোষিত দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তারা কাজ করবে।

সংলাপে ইভিএমে ভিভিপিএটি (এ ব্যবস্থায় একজন ভোটার ভোট দেওয়ার পর প্রিন্ট করা একটি কাগজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে জমা হয়। এতে ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তা দেখতে পারেন) যুক্ত করা, ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা, নির্বাচনী ব্যয় বাড়ানো-কমানো, নির্বাচনী ব্যয় তদারক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিধানে পরিবর্তন আনা, সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব ছিল রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের। এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধনী আনতে হবে। তবে আরপিও সংশোধনের জন্য ইসি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি।

ইসির সংলাপে বেশির ভাগ দল নির্বাচনকালীন সরকারে কোনো না কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছিল। অবশ্য নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেওয়া প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করার এখতিয়ার ইসির নেই। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসি যদি মনে করে এসব প্রস্তাবের বাস্তবায়ন না হলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়, তাহলে তাদের দায়িত্ব হলো এটি সরকারকে জানানো।

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংলাপে যেসব সুপারিশ এসেছিল, কমিশন পর্যালোচনাপূর্বক সারাংশ তৈরি করে সব অংশগ্রহণকারী দলনেতাকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। এ ছাড়া দলগুলোর সুপারিশসমূহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে আমাদের কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন শুরু করেছি, যেমন ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা ইত্যাদি। তবে সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ নির্বাচন কমিশনের নেই। রাজনৈতিক সমস্যা দলগুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধান করবে বলে আমরা আশা করি।’

আহসান হাবিব খান জানান, আলোচনার জন্য ইসির দরজা সব সময় খোলা। যেকোনো দল যেকোনো সময় আলোচনার জন্য কমিশনে আসতে পারে। সব অংশীজনের সহযোগিতায় অবাধ, সুষ্ঠু, নিরেপক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা তাঁদের ঐকান্তিক ইচ্ছা।

তবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে আনতে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তা নেই ইসির। শুধু সব দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে যাবে। ইসি বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছিল। সিসিটিভিতে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র দেখে গাইবান্ধা–৫ আসনের ভোট বাতিলও করেছিল। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে সরকারি দলের কোনো কোনো নেতার সমালোচনার মুখে পড়ে ইসি। এরপর ইসি সিসি ক্যামেরা ব্যবহার থেকে পিছু হটে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইসির সংলাপে কোনো সুনির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি ছিল না। ইসি কী উদ্দেশ্যে সংলাপ আহ্বান করেছিল, সেটাও পরিষ্কার ছিল না। এই সংলাপের কোনো কার্যকারিতা তিনি দেখছেন না।