সাগর, নদী, পাহাড় বা বনে ঘেরা দেশের পর্যটন স্থানগুলো। প্রতিবছর বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা। এ সুযোগে যেখানে–সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে রিসোর্ট, রেস্তোরাঁসহ বিনোদনের নানা কেন্দ্র। এসব গড়তে মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। এসব কেন্দ্র তৈরির ক্ষেত্রে বাদ যাচ্ছে না প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাও। আদতে এমন অপরিকল্পিত বিনিয়োগ ঝুঁকি তৈরি করছে পর্যটনশিল্পে।
পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত স্থানের বাইরে দেশে তেমন পর্যটনকেন্দ্র নেই। তাই পরিবেশ ধ্বংস হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারানো এলাকায় মানুষ আর বেড়াতে যাবে না। তাই দীর্ঘমেয়াদে পর্যটনশিল্পের স্বার্থে পরিবেশকে বাঁচাতে হবে।
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। পর্যটনশিল্পে পরিবেশ-প্রতিবেশ টিকিয়ে রাখতে এবার জাতিসংঘের বিশেষ সহযোগী সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও)’ নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। এ বছর পর্যটন দিবসে সবুজ বিনিয়োগকে স্লোগান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। দেশেও এবার দিনটির প্রতিপাদ্য ‘পর্যটনে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ’। আজ বুধবার থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল’ করবে ট্যুরিজম বোর্ড।
দেশে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। পর্যটন ধরে রাখতে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ হতেই হবে।তৌফিক রহমান, মহাসচিব, প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
দেশের পর্যটন খাতে এখন পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ তেমন একটা হয়নি। হাতে গোনা কিছু রিসোর্ট করা হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। দেশের ভেতরে পর্যটনের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য কক্সবাজার। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগও হয়েছে এখানে। কিন্তু কোনো পরিকল্পনা ছাড়া। গত কয়েক বছরে সেন্ট মার্টিন ও সাজেকেও অনেকে বিনিয়োগ করেছেন। তবে এসব বিনিয়োগে দ্বীপ ও পাহাড়ের সবুজের বুক চিরে গড়ে উঠছে কংক্রিটের ভবন। সুন্দরবন, টাঙ্গুয়ার হাওর ও কাপ্তাই হ্রদে নামছে একের পর এক ইঞ্জিনচালিত নৌকা। শব্দ আর কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে সেসব স্থানে।
কয়েক বছর আগে নড়াইলে ‘পরিবেশবান্ধব’ অরুণিমা রিসোর্ট গড়েছেন খবির উদ্দিন আহমেদ। তিনি ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, করোনা মহামারির পর থেকে পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনে আগ্রহ বেড়েছে বিশ্বজুড়ে। তাই পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট বাড়াতে হবে।
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষা করতে হলে সেন্ট মার্টিনে ভারী স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। ৩৮ বছরে সেন্ট মার্টিনে প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। কমেছে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা।
আবার এই দ্বীপে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ অবৈধ। অথচ আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ হয়েছে ২৩০টির বেশি। দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে ৪০টির বেশি বহুতল ভবনের (দুই ও তিনতলা) হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে। এ দ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা সীমিত করতে চায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে পর্যটন মন্ত্রণালয় চায় না এই সংখ্যা কমাতে। বর্তমানে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ৭ থেকে ১০ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিনে যান।
মহাপরিকল্পনা
পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পাঁচটি লক্ষ্য ঠিক করেছে ট্যুরিজম বোর্ড। এসব লক্ষ্যের শুরুতেই আছে পর্যটকদের জন্য যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণের সময় যাতে প্রাণিকুল, উদ্ভিদ, পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি না হয়, সেই বিষয়ে খেয়াল রাখা। এ ছাড়া সাধারণ মানুষকে সচেতন করাও লক্ষ্যগুলোর একটি।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের পর্যটন পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর। পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ উৎসাহিত করা ও পরিবেশ রক্ষায় ২০২৪ থেকে ২০৪১ মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
বিপন্ন পরিবেশ
সর্বশেষ ২০১৯ সালে দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে আছে দেশে পর্যটনের জনপ্রিয় গন্তব্য কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্রসৈকত, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সুন্দরবন, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর ও জাফলং-ডাউকি নদী। এসব এলাকা নিয়ে ৯ ধরনের বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। তবে তা মানা হচ্ছে না কোথাও। সবখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে খামখেয়ালিভাবে।
সুন্দরবনের প্রতিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। পরিবেশবান্ধব পর্যটনে বনের মধ্যে সাতটি এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ নিতে পারছে না এসব এলাকা। পর্যটকেরা ছড়িয়ে পড়ছেন বনের বিভিন্ন প্রান্তে। বন ঘিরে ঘুরছে শতাধিক পর্যটকবাহী নৌযান। এদিকে গত দুই দশকে রিসোর্ট, পিকনিক স্পটের নামে হাজার হাজার একর জমি উজাড় হয়েছে গাজীপুরে।
প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব তৌফিক রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কংক্রিটের ভবনের ছড়াছড়ি, সুন্দরবনে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে শব্দ করে চলছে নৌকা। দীর্ঘ সময় পর্যটন ধরে রাখতে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগে হতেই হবে। এ খাতে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে।
পর্যটকের সংখ্যা
দেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কম। ট্যুরিজম বোর্ড বলছে, গত বছর ৫ লাখ ২৯ হাজার বিদেশি এসেছেন দেশে। এবার এটি ৬ লাখ ছাড়াতে পারে। তবে এ সংখ্যার সঙ্গে একমত নয় ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, এটা সব মিলে দেশে আসা বিদেশির হিসাব। এর মধ্যে পর্যটক অনেক কম। তবে স্থানীয় পর্যটক বাড়ছে। বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় আনুমানিক দেড় থেকে দুই কোটি মানুষ ঘুরে বেড়ান। অবশ্য এর কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে।