ফিরোজার মাটির ঘরের টালির চালায় একটা মিষ্টিকুমড়ার গাছ আছে। সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটার তৈলকূপি গ্রামের এ বাড়ির উঠানে পেয়ারা আর পুঁইশাকের গাছগুলো দুই ছেলেকে নিয়ে লাগিয়েছেন ফিরোজা খাতুন। বাড়ি মানে গরুহীন এক গোয়ালঘর আর একটা থাকার ঘর। সেই ঘরে আবার দরজা–জানালা মানে কোথাও পেরেক দিয়ে কাঠ-তক্তা লাগানো, কোথাও পাটি ঝোলানো। তবে এসব সীমাবদ্ধতা উতরে গিয়েছেন ফিরোজা। আর একটি বছর পরেই স্নাতক পাস করবেন ৩৬ বছরের এই নারী।
চারজনের পরিবারে প্রধান উপার্জনকারী ফিরোজা একজন দিনমজুর। ভোর থেকে সকাল দশটার মধ্যে এক বেলার মাঠের কাজ শেষ করে ছুটে যান কলেজে। বিকেলে ফিরে আবার ছোটেন আরেক বেলার কাজ করতে।
ফিরোজার বাড়িতে বিদ্যুৎ–সংযোগ এসেছে দেড় বছর আগে। বিদ্যুৎ–সংযোগ আসার আগে হারিকেন, কুপি এমনকি বাঁশের খুঁটিতে টর্চলাইট দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে বই পড়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে তাঁকে। ভাত ফুটতে থাকা মাটির চুলার আলোয় পড়েছেন বই।
দুটি সন্তানই তাঁর মেধাবী। বাড়ির উঠানে পাটি পেতে সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে পড়তে বসেন তিনি। দুই ভাই তাদের শ্রেণিপাঠের বাংলা, ইংরেজি ব্যাকরণ বইটা পড়ে মায়ের পুরোনো বই দিয়ে।
কলেজের সময় হলে ফিরোজাকে কখনো কখনো ধানখেতের মাঠ থেকেই ছুটে যেতে হয় সাতক্ষীরা সদরের বিনেরপোতার অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান কলেজে। এই কলেজে বিএ দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করে তৃতীয় বর্ষে উঠেছেন তিনি। কখনো কখনো সন্তানেরা পথের মধ্যেই বই হাতে দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর জন্য।
বই নিয়ে ফিরোজা তৈলকূপি গ্রাম থেকে দৌড়ান কলেজের দিকে। মায়ের ফেলে যাওয়া কাজ শেষ করতে মাঠের দিকে ছোটে দশম শ্রেণিতে পড়া ছোট ছেলে। দিন শেষে মজুরি একজনের সমান।
ফিরোজার লড়াই
প্রথম আলোর প্রতিবেদক (কল্যাণ ব্যানার্জী) তৈলকূপিতে গিয়েছিলেন ফিরোজা খাতুনের সঙ্গে কথা বলতে। ২ সেপ্টেম্বর দুপুরে গনগনে রোদের মধ্যে ফিরোজা তখন মাঠে কাজ করছেন। প্রথম আলোকে জানালেন তাঁর জীবনের গল্প।
২০০০ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ফিরোজার বিয়ে হয় রফিকুল ইসলাম নামের এক মুদিদোকানির সঙ্গে। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বরাবরই ছাত্রী ভালো ছিলেন তিনি। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে পড়তে দেননি। স্কুলে যেতে চেয়ে শিকার হয়েছেন শারীরিক নির্যাতনের। এর সঙ্গে যোগ হয় স্বামীর নানা ধরনের বাজে আসক্তি। এর মধ্যেই দুটি সন্তানের মা হন তিনি। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করেছেন। ২০১২ সালে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পর সংসার ভাঙে। ছোট দুই সন্তান নিয়ে ফিরোজা ফিরে আসেন বাবার ভিটায়।
বিধবা মা ও দুই সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্বও পড়ে ফিরোজার কাঁধে। শুরু হয় উদয়াস্ত পরিশ্রমের জীবন। একা একা লড়াইটা করতে করতেও মনে হয়, আবার নতুন করে শুরু করতে হবে পড়ালেখা। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন স্থানীয় স্কুলে। ২০০২ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও পাস করেন ২০১৬ সালে। পাটকেলঘাটা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে জিপিএ–৪.৪৩ পেয়ে এসএসসি পাস করেন, দুই বছর পরে। এইচএসসিতে পেয়েছেন জিপিএ–৪.০৮।
সংসার ভেঙে যাওয়ার সময় বড় ছেলে ইয়াছিন আলী ছিল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। এখন সে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। ছোট ছেলে মোহসিন আরাফাত পড়ছে দশম শ্রেণিতে। ইয়াছিন সম্প্রতি তাদের কলেজ থেকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) একজন সেরা সদস্য নির্বাচিত হয়েছে।
জীবন এখন যেমন
ফিরোজা আজ কারও মাঠের জমিতে ধানের চারা রোপণ করেন, তো কাল কারও বাড়ির ধানের কুঁড়া ঝাড়েন। মাঝেমধ্যে যান মাটি কাটতে। এখন পাঁচ ঘণ্টা কাজ করলে দিনে দেড় শ টাকা পান। ছোট ছেলেটা পড়ালেখার পাশাপাশি কাঠমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে দিনপ্রতি ২০ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করেছে বছর দু-এক আগে। সম্প্রতি দিনে আয় বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা।
ফিরোজা খাতুনের বাড়ি থেকে ফেরার পথে কথা হলো তৈলকূপি বাজার এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। সেখানকার আশরাফ সরদারের চায়ের দোকানে বসে মইনউদ্দিন শেখ আর সূর্যকান্ত বাছার প্রথম আলোকে বলছিলেন, ফিরোজা শুধু নিজেই পড়ছেন না, দুই ছেলেকেও পড়ালেখা করাচ্ছেন। এই মেয়েটি এখন তাঁদের এলাকার গর্ব।
ফিরোজা সম্পর্কে বললেন তাঁর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সরদার রমেশ চন্দ্র। গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে বললেন, এত কষ্ট করলেও ফিরোজা কখনো কলেজে আর্থিক সহায়তার আবেদন করেননি। তিনি নিজে পড়ছেন, সন্তানদেরও পড়াচ্ছেন—এটা আমাদের জন্য গর্বের।
অতিসম্প্রতি ফিরোজার বাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁর বড় ছেলে ইয়াছিনের কলেজশিক্ষক ইদ্রিস আলী। প্রথম আলোকে জানালেন, এমন অমানুষিক পরিশ্রমের পরও এভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত শুধু একটি নির্দিষ্ট এলাকা নয়, পুরো দেশের সব প্রান্তিক মানুষের জন্য উৎসাহের।
অনেক দূর পড়তে চান ফিরোজা
৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যখন ফিরোজার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল, তখনো দুপুরের ভাত খাওয়া হয়নি তাঁর। মাঠে কাজ করছিলেন। সেদিনের একমাত্র তরকারি কাঁচা কলার ঝোল। দুপুর আর রাতের খাবার একবারে খাবেন ফিরোজা। স্বগতোক্তি করলেন, এক বেলার খাবার তো বাঁচল!
ফিরোজা জানালেন, যত দূর পড়ালেখা আছে করতে চান। বললেন, কয়েক বছর আগেও বই–খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়া দেখে যারা টিপ্পনী কাটত, তারাই এখন তাঁকে নিয়ে গর্ব করে। নিজের ও সন্তানদের লেখাপড়া এগিয়ে নিতে সবার দোয়া চাইলেন ফিরোজা।