প্রতিবাদী শিল্পে একুশের চেতনা

রফিকুন নবীছবি: আশরাফুল আলম

ভাষা ও সংস্কৃতি পরস্পরের পরিপূরক। এক সূত্রে গাঁথা। অভিন্ন। একটিকে খর্ব করলে অন্যটির অস্তিত্ব বিড়ম্বিত হয়। আমাদের দেশ তেমন বিপর্যয়ে পড়েছিল ১৯৪৭-এ ভারত ভাগের ব্রিটিশ দুর্মতির কারণে। আমাদের এই ভূখণ্ডকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম দেওয়া হয়েছিল।

নামকরণেই অচেনা সংস্কৃতি থেকে আহরিত ভিন্ন ভাষা ‘পাকিস্তান’ শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষ সাংস্কৃতিকভাবেও ভিন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাক—এমনটাই ভাবা হয়েছিল।

ফলে গণরোষ সৃষ্টি হতে সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। ছাত্ররা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকায় ক্রমেই তা সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে বিস্তৃত হয়। একই সময় কলকাতা থেকে চলে আসা প্রথিতযশা শিল্পীবৃন্দ ঢাকায় চারুকলা শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। ঘটনাটি বিভ্রান্তিতে থাকা দেশের সাংস্কৃতিক দিকটিতে উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। কারণ, প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠানটির ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণসহ তাঁদের সৃষ্ট প্রতিবাদী শিল্পকর্মের মাধ্যমে।

জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ারুল হক প্রমুখ অবিভক্ত ভারতেই খ্যাতিমান এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন শিল্পী হিসেবে। তাঁরা সবাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। চল্লিশের দশকে অপরাজনীতি এবং ধনবানদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে সৃষ্ট ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকে নিয়ে প্রতিবাদী চিত্রকলা এঁকে শিল্পী জয়নুল চিত্রকলার ক্ষেত্রে বিশ্বের শিল্পকলা জগতে খ্যাতি অর্জন করেন। কামরুল হাসানও সে সময় বেশ কিছু গুরুত্ববাহী ছবি এঁকেছিলেন।

সেই সময় থেকে প্রতিবাদী চেতনালব্ধ হওয়া শিল্পীদের যে চিরকালীন স্বভাব, তা ভাষা আন্দোলনে শিল্পকলার নব্য ছাত্রদের মধ্যে প্রবলভাবে সঞ্চারিত হয়। অতএব রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন ক্রমেই রাজনৈতিকতায় পর্যবসিত হতে থাকলে আপামর জনগণের সঙ্গে চারুশিল্পীবৃন্দও সম্মুখসারিতে যুক্ত থাকেন।

ভাষা আন্দোলন বেগবান হওয়ার চূড়ান্ত পর্বটি শুরু হয় ১৯৫২ সালে। মুহুর্মুহু মিছিল আর স্লোগানে প্রকম্পিত ঢাকা শহরে একসময় সরকার মিছিলে গুলি করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করে। অবশেষে ঘটনাটি সংঘটিত হয় বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন) তারিখে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রনীতির ভিত নড়ে যাওয়ার ইতিহাসের শুরুর সেই ঘটনার সময়ে মিছিলে বরকতদের সঙ্গে শামিল ছিলেন চারুকলার ছাত্ররা। শিল্পী আমিনুল ইসলাম, বিজন চৌধুরী, ইমদাদ হোসেন, মুর্তজা বশীরসহ প্রায় সব ছাত্রই ছিলেন সেই মিছিলে। মুর্তজা বশীর ছিলেন বরকতের সঙ্গে। গুলিতে নিহত বরকতের নিথর দেহ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। বরকতের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল তাঁর জামাও।

সেই সময়ের অভিজ্ঞতার দৃশ্য ড্রয়িং করেছিলেন তিনি। এঁকেছিলেন অন্যান্য শিল্পীও। সেসব ছবি ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী হয়ে আছে। বলা বাহুল্য, তাঁদের সেই সাহসী ভূমিকা, প্রতিবাদী চেতনা শুধু বাংলা ভাষা নয়, বাঙালি সংস্কৃতিকেও রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠার ইতিহাস হয়ে আছে।