বিশেষ সাক্ষাৎকার: কৃষ্ণেন্দু বোস

‘বাংলাদেশের গণহত্যার কথা বিশ্ববাসী জানে না’

ভারতীয় নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু বোস তাঁর বে অব ব্লাড বা রক্তের সাগর প্রামাণ্যচিত্রটি নিয়ে গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশে এসেছেন। ছবির বিষয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের চালানো গণহত্যা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আজ শনিবার ছবিটি প্রদর্শিত হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। কৃষ্ণেন্দু বোসের বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র যুক্তরাষ্ট্র, রোমানিয়া ও ইতালিতে পুরস্কার পেয়েছে। বতর্মানে তিনি এশিয়ান একাডেমি ক্রিয়েটিভ অ্যাওয়ার্ডস, সিঙ্গাপুরের ভারতীয় শুভেচ্ছাদূত। বে অব ব্লাড নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজনীন আখতার

কৃষ্ণেন্দু বোস
প্রশ্ন:

বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হলেন কেন?

কৃষ্ণেন্দু বোস: এই গল্প শুধু বাংলাদেশের একার নয়। এটা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, রাষ্ট্র ছাপিয়ে মানবতার গল্প। ২০১৯ সালে এই প্রামাণ্যচিত্রের কথা বলার ও তহবিল সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশে গিয়েছিলাম। আমার কাছে এটা ভীতিকর লেগেছিল যে তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর ইহুদি হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে রুয়ান্ডা, বসনিয়া, কম্বোডিয়ায় সংঘটিত গণহত্যার কথা জানলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ গণহত্যার কথা কেউ জানে না। ওই সময় আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি যে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করব। বাঙালি হওয়ার কারণে এই ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নির্যাতনের বিষয়টি আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। যখনই বাংলাদেশ বা অন্য কোথাও এই গণহত্যার ভুক্তভোগী বা প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের ব্যথা আমি অনুভব করতে পেরেছি।

প্রশ্ন:

বাংলাদেশের গণহত্যার কথা যে কেউ জানে না, এই উপলব্ধি কোথায় হলো?

কৃষ্ণেন্দু বোস: আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আর্থকেয়ার প্রোডাকশনস থেকে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের কাজে হাত দিই ২০১৯ সালে। ওই বছরের অক্টোবরে নির্মাণাধীন প্রামাণ্যচিত্রের একটি ট্রেলার নিয়ে ফ্রান্সে একটি সম্প্রচার সভায় যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়াসহ সারা বিশ্বের টেলিভিশন, ওটিটি ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে লোকেরা অংশ নিয়েছিলেন। ট্রেলারটি দেখানোর পর তাঁরা প্রত্যেকে বিস্মিত হয়ে যান। বলেন, বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে তাঁরা কখনো শোনেননি। একই বছরের ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুরে এশিয়ান ফেস্টিভ্যালেও ট্রেলারটি দেখিয়ে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। শুধু দক্ষিণ এশিয়া থেকে লোকেরা গণহত্যার বিষয়টি জানতেন। খারাপ লেগেছিল এই ভেবে যে বাংলাদেশে এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে, অথচ কেউ তা জানেন না।

প্রশ্ন:

আপনার প্রামাণ্যচিত্রে কি দুর্লভ কোনো ফুটেজ আছে?

কৃষ্ণেন্দু বোস: আমরা এমন কিছু ফুটেজ খুঁজে পেয়েছি, যা খুব কম লোকই দেখেছেন। যেমন ওভাল অফিসে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আর তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যকার আলাপ খুব কম মানুষই শুনেছেন। প্রামাণ্যচিত্রটিতে বিশ্বরাজনীতির গল্পটিও বলা হয়েছে, যার কারণে এই দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অপরাধ সংঘটিত করেছিল। বিশ্ববাসীকে এসব খুব কমই জানানো হয়েছে।

প্রশ্ন:

ভারতের কিছু চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধে পর্যবসিত করা হয়। আপনার প্রামাণ্যচিত্রের বয়ানটা কেমন?

কৃষ্ণেন্দু বোস: প্রামাণ্যচিত্রটি দেখলেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে আমার কোনো পক্ষপাত নেই। আমি তথ্যপ্রমাণ আর ঘটনার মধ্যেই থেকেছি। প্রামাণ্যচিত্রে প্রত্যক্ষদর্শীদের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। ভারত ১৩ দিনের লড়াই করেছিল। এরপর জয় এসেছে। কিন্তু লড়াইটা তো এই ১৩ দিনের ছিল না। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তবে ঘটনাপ্রবাহ ছিল ২৫ বছরের। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার দিন পর্যন্ত। প্রামাণ্যচিত্রের শেষে স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও এসেছে। এর মধ্য দিয়ে গণহত্যার প্রভাব নিয়ে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন:

বার্তাটি কি একটু বলবেন?

কৃষ্ণেন্দু বোস: আর্জেন্টিনার গণহত্যাবিষয়ক শিক্ষাবিদ দানিয়েল ফায়ারস্টাইনের বক্তব্য প্রামাণ্যচিত্রটিতে ফিরে ফিরে এসেছে। তিনি বাংলাদেশের গণহত্যার গবেষক। তিনি সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী দুম করে একদিন ২৫ মার্চে গণহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়নি। এই গণহত্যার প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল। কীভাবে প্রক্রিয়াটি তৈরি হয়েছিল, সেটা তিনি বর্ণনা করেছেন। শেষে তিনি বলেছেন, একটি দেশ স্বাধীন হলে সেই গণহত্যাকে ব্যর্থ বলা হয়। কিন্তু দেখা গেল, স্বাধীন বাংলাদেশেও গণহত্যা সফল হতে পারে, জাতির আত্মপরিচয় বদলে যেতে পারে। আমি মনে করি, গণহত্যার যে বীজ রোপণ করা হয়েছিল, বাংলাদেশে তা বড় হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। বহু বছর দেশটিতে গণতন্ত্র ছিল না।

প্রশ্ন:

মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় ১ কোটি শরণার্থী নিয়ে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কেমন শুনেছেন?

কৃষ্ণেন্দু বোস: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমার নিজের কোনো অভিজ্ঞতার কথা মনে করতে পারি না। তবে এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে আমি ভারত ও বাংলাদেশ দুই পক্ষের মানুষের কাছে ইতিবাচক কথাই শুনেছি। প্রামাণ্যচিত্রে সেটাই উঠে এসেছে। অনেক বাংলাদেশি বলেছেন, ত্রিপুরার দিকে কোনো কোনো ভারতীয় পরিবার তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য নিজের বাড়িও ছেড়ে দিয়েছিল।

প্রশ্ন:

প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে কি কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল?

কৃষ্ণেন্দু বোস: ৯০ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্রে ২৫ বছরকে তুলে আনতে গিয়ে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। ৪০ ঘণ্টার ফুটেজ ধারণ করতে হয়েছে। বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে ৩০ মিনিটের তথ্য নেওয়া হয়েছিল। চিত্রগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর আর্জেন্টিনায় ছুটতে হয়েছে। ২০১৯ সালে কাজটি শুরু করলেও কোভিডের কারণে প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে ওই সময় জুমে বিভিন্ন দেশের গবেষকদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। সেটা প্রামাণ্যচিত্রটিকে সমৃদ্ধ করেছে।

প্রশ্ন:

বাংলাদেশ থেকে কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন?

কৃষ্ণেন্দু বোস: জনসাধারণের চলাচলের নানা জায়গায় চিত্রগ্রহণের কাজ হয়েছে। সেটার জন্য অনুমতি নেওয়া ছাড়া তেমন কোনো সহযোগিতা সরকারের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পেয়েছি, তা অসাধারণ। গণহত্যা আর মুক্তিযুদ্ধের কথা বলার জন্য তাঁরা ছুটে এসেছেন। তাঁরা ভোলা, চুকনগর ও শেরপুরে চলে এসেছিলেন। ঢাকার ব্যস্ত মানুষেরাও এই প্রামাণ্যচিত্রের জন্য সময় দিয়েছেন। তাঁরা শুধু নিজেদের সাক্ষাৎকারই দেননি, ২৫ বছরের ইতিহাসের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমাদের সাহায্য ও পরামর্শ দিয়েও প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণে দারুণ অবদান রেখেছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আর্জেন্টিনার শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, সাংবাদিক এবং নিক্সন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এই প্রামাণ্যচিত্রের জন্য সময় দিয়েছেন।

প্রশ্ন:

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

কৃষ্ণেন্দু বসু: আপনাকেও ধন্যবাদ।