জনশুমারি
সাড়ে চার কোটি তরুণের দেশ
উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে শিক্ষার গুণগত মান ও দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগই এখন তরুণ। যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। সংখ্যার হিসাবে, তরুণ জনগোষ্ঠী এখন ৪ কোটি ৫৯ লাখ। জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদনে (প্রাথমিক) এ তথ্য উঠে এসেছে।
তরুণ জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বিশাল হলেও তাঁদের কতটা ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ। অন্যদিকে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
গত বুধবার প্রকাশিত জনশুমারির তথ্য বলছে, দেশে এখন জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক বিভাজন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা ৯ শতাংশ। ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। সাধারণত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের তরুণ-যুব জনগোষ্ঠী ধরা হয়।
দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, এটি যেমন সত্য। তেমনি তরুণদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না, এটিও বাস্তবতা।মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের
এখন দেশের মোট জনসংখার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশের বয়স ৬০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে। আর ১ থেকে ৫৯ বছর বয়সীরা মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯০ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
জনশুমারির তথ্য বলছে, দেশের জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশই তরুণ। সংখ্যায় সাড়ে চার কোটির বেশি তরুণ ও যুব জনগোষ্ঠীই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নির্মাতা।
তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার কী ভাবছে, জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তরুণদের কাজে লাগাতে সরকার বাজেটে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। শিক্ষায় জোর দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হচ্ছে। বিশেষ করে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর আশা, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে তরুণদের গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হবে।
অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, মাধ্যমিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখনো ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে আছে। এর মধ্যে ইংরেজিতে বেশি খারাপ। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের খারাপ বা গড়পড়তা অবস্থা। ‘মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জাতীয় মূল্যায়ন-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ বিষয় উঠে এসেছে।
দেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়েও বড় প্রশ্ন আছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন।
২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন। বিআইডিএস এ গবেষণা করেছে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনে।
সরকারি সংস্থা বিআইডিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি। ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, এটি যেমন সত্য। তেমনি তরুণদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না, এটিও বাস্তবতা।
জনমিতির লভ্যাংশকে (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) সফল করতে চাইলে তরুণ জনগোষ্ঠী যাতে গুণগত শিক্ষা পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। তাঁদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। সরকার যদি তরুণদের গুণগত শিক্ষা দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে না পারে, তাহলে জনমিতির লভ্যাংশের সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।