বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকার মুসলমানদের নিয়ে কীভাবে আপনার আগ্রহ তৈরি হলো?
নাভিন মুর্শিদ: সীমান্ত এলাকার মুসলমান জনগোষ্ঠীর অবস্থা নিয়ে আমার ধারাবাহিক গবেষণার শুরুটা ছিল ভারতীয় প্রেক্ষাপটে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম অঞ্চলের সব ধরনের গবেষণা ও জরিপে দেখা যেত, সব সূচকে সবচেয়ে নিচের দিকে মুসলমানদের অবস্থান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামগ্রিকভাবে আর্থসামাজিক দিক থেকে তাঁদের অবস্থা সবাই জানে।
একটি গবেষণা ফেলোশিপের অংশ হিসেবে ২০১২ সালে ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) গিয়েছিলাম। সেখানে অবস্থানকালে আসামের কোকড়াঝাড়ে একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু কাউকে গ্রেপ্তার বা কোনো তদন্ত শুরুর আগেই ভারতের গণমাধ্যমে লেখা শুরু হলো—এর সঙ্গে বাংলাদেশি মুসলমানরা জড়িত। বিষয়টি আমাকে বেশ অবাক করল। কোনো সূত্র বা তথ্য ছাড়াই প্রকাশিত এসব খবর সবাই বিশ্বাসও করল। এ ঘটনা আমাকে বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী করে তোলে। আসামে গিয়ে সেখানকার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা সবাই একবাক্যে ওই ঘটনার জন্য বাংলাদেশি মুসলমানদের দায়ী করলেন। এতে আমি আরও আগ্রহী হলাম। সেখান থেকে আমার প্রথম বইয়ের গবেষণা শুরু।
ভারতের অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে রাস্তাঘাট ভালো নয়। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুবই কম।
সীমান্ত এলাকার অধিকাংশ মানুষ এখনো অর্থনৈতিকভাবে খুবই দরিদ্র।
স্থলবন্দর ও সীমান্ত হাট হলেও স্থানীয় মানুষ সেগুলোর সুফল পাচ্ছেন না।
সীমান্তের মানুষের সমস্যা চিহ্নিত করে নীতিনির্ধারকদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আসামে গিয়ে কী দেখলেন?
নাভিন মুর্শিদ: আমি শুরু থেকে মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন নিয়ে এগোলাম। কাদের বাংলাদেশি বোঝানো হচ্ছে, তারা কারা। আমি আসামে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা সবাই বলে উঠলেন, ‘দেখুন, আমরা বাংলাদেশিদের দিয়ে ঘেরাও হয়ে যাচ্ছি। ওই যে রিকশাওয়ালা, মাটি কাটার শ্রমিক এমনকি ওই যে হিজড়া—এরা সবাই বাংলাদেশি। এরা আমাদের সব সমস্যা তৈরি করছে।’ এ ধরনের কথা বেশি শুনলাম। তার অর্থ, বাংলাদেশিদের দিক থেকে তাঁরা কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিযোগিতা অনুভব করছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের শাসন-শোষণ চালানোর ক্ষেত্রে বাঙালিদের ব্যবহার করেছে। ফলে তারা ঐতিহাসিকভাবে বাঙালিদের শত্রু মনে করে। আসামে ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন হয়েছে।
আসামের মানুষ যাঁদের ‘বাংলাদেশি’ বলছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কী বুঝলেন?
নাভিন মুর্শিদ: তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, এঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে এসেছেন। তাঁদের বড় অংশই ভারতীয় মুসলমান। তাঁদের মধ্যে যে দু-একজন বাংলাদেশি মুসলমান নেই, তা কিন্তু নয়। তবে আসামের মানুষ সবাইকে বাংলাদেশি বলে যে তাঁরা চিহ্নিত করছেন, সেটা ঠিক নয়।
তাহলে কেন মুসলমানদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে?
নাভিন মুর্শিদ: এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দাদের অবস্থা বুঝতে হবে। ভারতের আট-দশটা এলাকাকে যেভাবে দেখা হয়, সীমান্ত এলাকাকে দেখা হয় তার চেয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে। প্রথমত ভারত রাষ্ট্রে এমনকি পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মতো রাজ্যের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, সীমান্ত এলাকায় মুসলমান জনগোষ্ঠী বেশি। সেখানে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুব কম। ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য—দুই সরকারের মধ্যে একধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সীমান্ত এলাকায় সব বাংলাদেশি মুসলমান। তাদের জন্য ‘উন্নয়ন’ দিয়ে কী হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দিক থেকে আমরা দৃষ্টি দিলে দেখি, ভারতীয় অংশের সীমান্ত এলাকার তুলনায় বাংলাদেশ অংশে রাস্তাঘাট ভালো। ভারতীয় অংশে কাঁচা রাস্তা বেশি, বাংলাদেশ অংশে পাকা। হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘উন্নত’। সাধারণভাবে একটি ধারণা প্রচলিত আছে, বাংলাদেশিরা অর্থনৈতিক কারণে ভারতে বেশি যায়। আমি উল্টো ঘটনাও দেখেছি। ভারতীয় সীমান্ত এলাকার প্রচুর মানুষ সেবা নিতে বাংলাদেশের হাসপাতালে আসে।
সীমান্ত এলাকার আলাদা একটি বিশেষত্ব রয়েছে, যা দুই দেশের অন্য এলাকার মানুষ কখনো বোঝার চেষ্টা করেনি। সেটা হচ্ছে, সীমান্ত এলাকার আলাদা একটি সমাজকাঠামো আছে। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অন্য এলাকার চেয়ে আলাদা। হয়তো তাদের পরিবারের একটি অংশ ভারতের সীমান্ত এলাকায় থাকে, আরেকটি অংশ বাংলাদেশে। তাদের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত ও বাণিজ্য চলে। এটা তাদের কাছে খুব স্বাভাবিক। দেশভাগের পর তাঁদের অনেকে দুই দেশের প্রান্তীয় এলাকায় থেকে গেছেন। যেমন অনেকে সিলেট সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসামের রাজধানী বা বড় শহরে যেতে পারেননি।
তাঁরা তো প্রায় ৭৬ বছর ধরে আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে আছেন? অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ধনী হয়েছেন, অনেকে পড়ালেখা করে রাষ্ট্রের বড় দায়িত্বে গেছেন। তাহলে সীমান্ত এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব নেই কেন?
নাভিন মুর্শিদ: দেশভাগের পর সীমান্ত এলাকার বাণিজ্য অনেক বেশি অবৈধ বাণিজ্যকেন্দ্রিক ছিল। ওই বাণিজ্য করে অনেকে ধনী হয়েছেন। তাঁরা সীমান্ত এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য সীমান্তকেন্দ্রিক হলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো আর সেখানে ছিল না। তাঁরা দেশের মূলধারায় মিশে গেছেন। নানা রাজনৈতিক কারণে সীমান্ত এলাকার উন্নয়নে তাঁরা ভূমিকা রাখেননি।
দেশের সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত হাট, স্থলবন্দরসহ নানা অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। সেগুলো সীমান্তের মানুষের জীবনকে কতটুকু স্পর্শ করেছে?
নাভিন মুর্শিদ: সীমান্ত এলাকায় এখন যাঁরা থাকেন, তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর অংশ। তাঁদের বড় অংশ এখনো সীমান্তে অবৈধ পণ্য বাণিজ্যের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। সীমান্তে যেসব অবকাঠামো হয়েছে, সেগুলোর সুবিধা তাঁরা পান না। তাঁদের চোখের সামনে বড় বড় রাস্তা হয়েছে, রেললাইন হয়েছে। স্থলবন্দর ও সীমান্ত হাটে বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি তাঁরা দেখছেন। কিন্তু এসবের মাধ্যমে তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
তাঁরা সেখানে বড়জোর শ্রমিক ও দিনমজুর হিসেবে কাজ পাচ্ছেন। পৃথিবীর নিউ লিবারেল উন্নয়নের (নয়া উদারতাবাদ) যে মডেল তৈরি হয়েছে, সীমান্ত এলাকায়ও সেই ঘটনা ঘটছে। যেমন আসাম ও মেঘালয়ের মতো রাজ্যের খনিতে বিনিয়োগের সময় বড় বড় কোম্পানি একই ধরনের আশ্বাস দেয়। বলে, তারা কাজ করলে স্থানীয়রা কাজ পাবে। এলাকার উন্নয়ন হবে। যুক্তরাষ্ট্রেও একই ধরনের উন্নয়ন মডেল দেখা যায়। কোথাও তা সফল হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকায়ও হয়নি।
চোরাচালানের বাইরে অন্য কোনো পেশায় তাঁরা যেতে পারছেন না কেন? সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অনেক বাংলাদেশি ভারতে যান বলেও অভিযোগ আছে।
নাভিন মুর্শিদ: বাংলাদেশিরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। এই কথাই আমরা বেশি শুনি। বিশেষ করে হিন্দুরা সবচেয়ে বেশি যান। তবে আমি গবেষণা করতে গিয়ে দেখি, মুসলমান ও হিন্দু উভয়েই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। তাঁদের বেশির ভাগই কাজের খোঁজে যান। কাজ শেষে ফিরে আসেন। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য খুব কম মানুষ যান বলে আমার মনে হয়েছে।
অন্যদিকে প্রচুর ভারতীয় বিশেষ করে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মানুষ কাজের জন্য বাংলাদেশে আসেন। তাঁদের বড় অংশ সীমান্ত এলাকার অধিবাসী। কাজ শেষে তাঁরা আবার ভারতে ফিরে যান। ঐতিহাসিকভাবে এটা ঘটছে। আমরা বিষয়টিকে আধুনিক রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার কারণে ভিন্নভাবে দেখি।
সীমান্ত এলাকার মানুষের সঙ্গে অন্যান্য এলাকার মানুষের কোনো মৌলিক পার্থক্য আছে?
নাভিন মুর্শিদ: আসলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মানুষের বসতির শুরু থেকে বিশেষ ধরন দেখা গেছে। সেটা হচ্ছে, এখানকার মানুষ বহির্মুখী। তাঁরা বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে এসে বসতি করেছেন। ফলে অন্য দেশ বা এলাকা তাঁদের কাছে নতুন কিছু নয়। এখানে বসতি শুরুর পর তাঁরা বিভিন্ন সময়ে এশিয়া, আরব ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছেন। ফলে সীমানা পাড়িতে তাঁরা অভ্যস্ত।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রচলনের পর এখানকার মানুষ দেখেছেন, চোখের সামনে দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক ও ট্রেন যাচ্ছে। এই যাতায়াত তাঁদের কাছে একটি স্বাভাবিক বিষয়। ফলে রাষ্ট্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও আইন তাঁদের কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পায় না। প্রয়োজনের নিরিখে তাঁরা সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ তাঁদের কাছে রাষ্ট্র। এর বাইরে তেমন কাউকে তাঁরা চেনেন না। বিএসএফের সঙ্গে সমঝোতা হলে সীমান্ত পাড়ি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করা তাঁদের জন্য বড় সমস্যা নয়।
আমি নিজেও সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে গিয়ে দেখেছি, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ দেশভাগের সময় বাংলাদেশ থেকে গেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামেও অনেক পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী দেশভাগের সময় ভারতীয় অংশে চলে গেছে। তবে সেখান থেকে তারা কলকাতা বা কেন্দ্রীয় অংশে বা শহরে যেতে পারেনি। আমরা দেশভাগের যেসব ঘটনা শুনি, তার বড় অংশ কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি লেখক বা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের স্মৃতিকাতরতার গল্প।
নাভিন মুর্শিদ: ঠিক তা–ই। সীমান্ত থেকে যাঁরা আর অন্য কোথাও যেতে পারেননি, তাঁদের ঘটনা আমরা খুব কমই জেনেছি। তাঁদের মধ্যে সফল মানুষও খুব কম। এঁদের কথা আমাদের কাছে খুব কমই এসেছে।
তাহলে সীমান্ত এলাকার মানুষের আর্থ–সামাজিক কোনো পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এভাবে থাকবে?
নাভিন মুর্শিদ: কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে পরিবর্তন হবে, তা বলার দায়িত্ব আমার নয়। আমি সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার বই ও লেখার মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরেছি। এখন সমস্যাগুলো ঠিকমতো বুঝে সমাধানের দায়িত্ব নীতিনির্ধারকদের। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকার মানুষের সমস্যার সমাধান হবে, নাকি এ জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার, সেটা তাঁরাই ঠিক করবেন।
আর নিউ লিবারেল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে শুধু সীমান্ত এলাকা নয়, বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নতি সম্ভব কি না, তা–ও একটি বড় প্রশ্ন। আমি এসব প্রশ্ন তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আগে সমস্যাগুলোকে স্বীকার করতে হবে। তারপর সমাধানের সত্যিকারের পথ বের হবে। আমাদের রাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, তারা সব সময় সমস্যাকে আড়াল করতে চায়, অস্বীকার করতে চায়। এতে সীমান্তের মতো সমস্যা আরও বড় হয়। সমাধান হয় না।