অসময়ের বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগ
ঢাকার অন্তত ১১টি এলাকায় জলাবদ্ধতা।
ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেটের অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন।
কাল রোববার থেকে বৃষ্টি কমতে পারে।
অসময়ের ভারী বৃষ্টিতে দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকার জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও রাজশাহীর পর গতকাল শুক্রবার ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগজুড়ে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। শহরে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়া থেকে শুরু করে গ্রাম এলাকায় হাটবাজার ও বাড়িঘর তলিয়ে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। অক্টোবরে পুরো মাসে সারা দেশে গড়ে ১৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। আর গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় শুধু কিশোরগঞ্জের নিকলীতে এর তিন গুণ বৃষ্টি ঝরেছে, যা দেশের ইতিহাসে এক দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। আর ময়মনসিংহ বিভাগের বেশির ভাগ জেলায় বৃষ্টি হয়েছে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি।
রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগের বেশির ভাগ জায়গা অতি ভারী বৃষ্টিতে ভিজেছে। একে তো সাপ্তাহিক ছুটির দিন, তার ওপর বৃহস্পতিবারের ভারী বৃষ্টির অভিজ্ঞতায় রাজধানীবাসী খুব জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে বের হয়নি। সকাল থেকে আকাশ কালো করে মেঘ থাকায় শহরজুড়ে স্থবিরতা নেমে আসে। তবে মাঝারি বৃষ্টিতেই পুরান ঢাকা থেকে নিউমার্কেট, মিরপুর রোড হয়ে কাজীপাড়াসহ অন্তত ১১টি এলাকায় দিনভর সড়কে পানি জমে থেকেছে। বৃষ্টি আর নির্মাণকাজের দাপটে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হয়। নাগরিকদের পড়তে হয় বাড়তি ভোগান্তিতে।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে প্রবল বৃষ্টির সময় রাজধানীর অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়। ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতেও একইভাবে রাতে বিদ্যুৎ চলে যায়। একদিকে প্রবল বৃষ্টি, অন্যদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনেকে সারা রাত ঘুমাতে পর্যন্ত পারেননি। প্রবল বৃষ্টি এসব জনপদে আতঙ্ক ও ভয় নিয়ে আসে।
গতকাল রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর কিছুটা স্বস্তির সংবাদ দিয়ে বলছে, আজ শনিবার সারা দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসতে পারে। তবে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় বৃষ্টি বেশি হবে। আগামীকাল রোববার থেকে বৃষ্টিপাত আরও কমে স্বাভাবিক আবহাওয়া ফিরতে পারে। আগামী সপ্তাহ থেকে বর্ষা মৌসুম বিদায় নিতে শুরু করবে। যাওয়ার আগে কিছুটা বৃষ্টি ঝরালেও তা খুব বেশি তীব্র হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে আবহাওয়াবিদেরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টির রেকর্ড কিশোরগঞ্জের নিকলীতে—৪৭৬ মিলিমিটার।
অন্যদিকে রাজশাহীর পর গতকাল ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জের নিকলী ও হবিগঞ্জে রেকর্ডভাঙা বৃষ্টি ঝরেছে। এসব শহরের বড় অংশ পানিতে ডুবে জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও জমে থাকা পানি নাগরিকদের হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত উঠেছে। এসব জেলায় সড়ক যোগাযোগ তো বটেই, রেললাইন ডুবে গিয়ে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। নৌযানগুলো কম চলাচল করেছে।
হবিগঞ্জে শুক্রবার ভোর চারটায় শুরু হওয়া বৃষ্টি গতকাল রাত ১০টায় পর্যন্ত চলছিল। শহরে বিদ্যুৎ ছিল না প্রায় ১৬ ঘণ্টা। অনেক স্থানে বন্ধ ছিল ইন্টারনেট সেবা।
ময়মনসিংহ শহরেও রাতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টিপাত, চলে গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত।
একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক তাঁর ফেসবুকের ওয়ালে লেখেন, ‘ঘুম থেকে উঠেই শুনি গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে আমার প্রিয় ময়মনসিংহ আর গৌরীপুর পানির নিচে। আমার জন্মের পর থেকে শুনি নাই আমার শহর বা গ্রামে বন্যার পানি, ১৯৮৮ বন্যা ছাড়া। ব্রহ্মপুত্র নদীর নাব্যতা যেভাবে কমেছে আর যেভাবে নদী–নালা, খাল–বিল দখল হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ অবস্থা হবে।’
কোথায় কতটা বৃষ্টি
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের নিকলীতে দেশের সর্বোচ্চ ৪৭৬ মিলিমিটার বৃষ্টি ঝরেছে, যা এ বছরে দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। এ ছাড়া গতকাল ময়মনসিংহে ৩৪০ ও নেত্রকোনায় ৩১১ মিলিমিটার বৃষ্টি ঝরেছে। আর রাজধানীতে হয়েছে ৮০ মিলিমিটার। এর বাইরে সিলেট বিভাগের সব জেলায় ১০০ মিলিমিটারের কাছাকাছি বৃষ্টি হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, এর আগে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত নোয়াখালীর হাতিয়ায়; ২০১৬ সালের ১১ অক্টোবরে সেখানে ৪০৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এর আগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল ময়মনসিংহে ১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর—৩৮১ মিলিমিটার।
অসময়ে এমন বৃষ্টি কেন
সাধারণত মৌসুমি বায়ু বিদায় নেয় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি। এ সময় দেশের বেশির ভাগ জেলায় ১৪০ থেকে ১৮০ মিলিমিটারের মতো বৃষ্টিপাত হয়। এই সময়ে সাধারণত দিনের বেলা ১০ থেকে ৪০ মিনিটের মতো বৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু তিন দিন ধরে যে বৃষ্টি হচ্ছে, তার বড় অংশ রাতে ঝরছে। দিনে আকাশ কালো করে মেঘ থাকলেও বৃষ্টি হচ্ছে কম। বেশির ভাগ বৃষ্টি হচ্ছে সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। ফলে এই সময় বৃষ্টিকে অসময়ের বৃষ্টি বলছেন আবহাওয়াবিদেরা।
আবহাওয়া গবেষকেরা এ সময়ে এত বৃষ্টির জন্য যে তিনটি কারণের কথা বলছেন, তার প্রথমটি হলো দেশের স্থলভাগে বর্তমানে দুটি স্থানে নিম্নচাপ একত্র হয়ে প্রচুর জলীয় বাষ্প ও বাতাস টেনে নিয়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, বঙ্গোপসাগরে ‘ভারত মহাসাগর দ্বিচক্র—আইওডি’ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, মৌসুমি বায়ু বিদায় নেওয়ার সময়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে বিপুল পরিমাণে মেঘ জড়ো করছে।
ওই তিন কারণ সাধারণত বাংলাদেশের ভেতরে এই সময়ে একত্র হয় না। এবার বর্ষার শেষ সময়ে এসে তা হওয়ার কারণেই অল্প সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে মৌসুমি বায়ুর শেষ অংশ বিদায় নিতে শুরু করেছে। এ সময়ে বৃষ্টি বেড়ে যায়। আর এর সঙ্গে একটি স্থল লঘুচাপ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে পূর্বাঞ্চলের দিকে চলে গেছে। মূলত ওই লঘুচাপের সঙ্গে আসা বিপুল পরিমাণ মেঘের কারণে বেড়ে গেছে বৃষ্টি। তবে শনিবার (আজ) থেকে বৃষ্টি ক্রমাগত কমে আসতে পারে।