১৩ বছর অপেক্ষার পর ছেলেকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়লেন বাবা

ঈদগাহে ছেলে ও বাবার সঙ্গে সাকলায়েন রাসেলছবি: সংগৃহীত

ছেলেকে নিয়ে একসঙ্গে ঈদগাহে যাবেন। ঈদের নামাজ আদায় করবেন। এমন স্বপ্ন দেখছিলেন বাবা। ভাবছিলেন, এই তো আর কিছুদিন। এরপর ছেলের হাত ধরে যেতে পারবেন ঈদগাহে।

কিন্তু ছেলের জন্মের পর মাস যায়, বছর যায়। ছেলের শরীরটা বড় হতে থাকে। মনটা ছোটই থেকে যায়। প্রতি ঈদেই মনে হতো, ‘না এবারও হলো না।’ এভাবে অপেক্ষা করতে করতে কেটে গেল ১৩ বছর। এবার স্বপ্নপূরণ হলো বাবার। এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করার সময় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন বাবা।  

১৩ বছরের ছেলে ফারজাদ আরিজ সাকলায়েনের মা ও বাবা দুজনই চিকিৎসক। তাই হয়তো নিজের সন্তান যে আর দশজন শিশুর চেয়ে আলাদা তা বোঝাটা তাঁদের পক্ষে সহজ হয়েছিল। যখন বুঝলেন, তখন ছেলেকে নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়েন এই মা-বাবা।

গত রোববার মুঠোফোনে সেই যুদ্ধের গল্প শোনালেন বাবা সাকলায়েন রাসেল। বললেন, ‘আরিজ এক যুদ্ধের নাম।’

ছেলে ফারজাদ আরিজ সাকলায়েনের সঙ্গে সাকলায়েন রাসেল
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান সাকলায়েন রাসেল এবার পরিবার নিয়ে রংপুরের মিঠাপুকুরে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করেছেন। বললেন, ‘ঈদের নামাজ আদায় শেষে মোনাজাতের সময় ছেলে আধো আধো বুলিতে  বলেছে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে সুস্থ করে দাও।’

ছেলে ও বাবার ঈদের নামাজের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন বাবা সাকলায়েন। তাতে লিখেছেন, মোনাজাতের সময় সবাই অনেক কিছু চেয়েছেন, তবে তিনি শুধু সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া আদায় করেছেন।

চিকিৎসক সাকলায়েন বললেন, মানুষ যাতে বিরক্ত না হয়, সে জন্য ছেলেকে নিয়ে মাঠের এক কোণে বসেছিলেন। নামাজ কেমন করে আদায় করতে হয় ছেলে ভালোভাবে বোঝে না। তবে মাঠে গিয়ে হাসিখুশি ছিল। তবে প্রতিবন্ধী ছেলেকে ঈদগাহে আনায় কিছু কটূক্তিও শুনতে হয়েছে তাঁকে।

আরিজের মা তারানাহ ফারিয়াহ মোনালিসাও চিকিৎসক। আরিজের বোনের নাম ফারিয়াত আরিবা সাকলায়েন, পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে।

আরিজ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিস্টিক) শিশু—এই সত্যটা চিকিৎসক হলেও মা-বাবা সহজে মানতে পারেননি। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ভেবেছেন ছেলে ঠিক হয়ে যাবে। পরে বাস্তবতা মেনে নেন। ছেলের কথা ফেসবুকে এক পোস্টেই জানান সাকলায়েন রাসেল। সেই পোস্টের শিরোনাম ছিল, ‘পাত্রী খুঁজছি আরিজের জন্য!’ সাকলায়েন রাসেল ওই পোস্টে লিখেছিলেন—‘তবে শর্ত আছে...পাত্রীর বয়স আরিজের বয়সের কমপক্ষে ৮ গুণ হতে হবে...আরিজকে সে সব সময় দেখে রাখবে...চোখে চোখে...খাওয়াবে...পরাবে...ঘোরাবে...জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে আমার আরিজকে দেখে রাখবে...! বিনিময়ে আমি তাকে সব দিয়ে দেব...আমার যত সম্পদ...যত অর্থ...সব...সবকিছু!’

বাবা বললেন, ‘আরিজের নানি মারা গেলে আরিজের মা মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। এরপর পেটের মধ্যে আরিজের উপস্থিতি টের পান। ফলে আরিজের জন্মটা ছিল অন্য রকম আনন্দের। আরিজকে ঘিরে স্বপ্নগুলোও দিন দিন যেন নাছোড়বান্দা হয়ে উঠল, কেউ বলে আরিজ বড় হলে ডাক্তার হবে, কেউ বলে ইঞ্জিনিয়ার...।’

প্রথম দিকে আরিজ মুখে দাদা বা কিছু বললেও দুই বছর বয়স থেকে তা–ও বন্ধ হয়ে যায়। রংপুর থেকে ঢাকায় এনে আরিজকে একজন অটিজম বিশেষজ্ঞ দেখানো হয়। তিনি বলেন, আরিজের মাইল্ড বা সামান্য অটিজম আছে। জন্ম নেওয়া প্রায় ১০ ভাগ শিশু অতিরিক্ত বুদ্ধিমান হয়, আরিজ তাদেরই একজন। কিন্তু বাবা হিসেবে সাকলায়েন চাচ্ছিলেন—বেশি বুদ্ধির দরকার নেই, অল্প বুদ্ধির সুস্থ আরিজকেই তাঁর চাই।

আরিজের মা সরকারি চাকরি করেন, তাঁর পোস্টিং তখন রংপুরে। মাকে ছেড়ে আড়াই বছর বয়সে আরিজকে ঢাকায় আনা হলো। তবে মায়ের জন্য কাঁদত না আরিজ, খুঁজত না কখনো। আসলে ও তো জানেই না মা কী জিনিস!

সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‘তখন আমাদের দুজনেরই ক্যারিয়ারের দিকে মন দেওয়ার কথা। কিন্তু আরিজকে নিয়ে যুদ্ধ শুরু হলো।’ আরিজের মা চাকরির জন্য ছেলের কাছে থাকতে পারছেন না, এটা শুনলে মানুষ কথা শোনাবে—আরিজের কথা এ কারণে গোপন রাখা হয় জানালেন তিনি।

সাকলায়েন আরও বললেন, ‘তবে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আরিজ যত বড় হবে, তত আমাদের সংগ্রামটা বাড়বে। তাই আরিজের মা চাকরি ছাড়তে পারেননি। গাইনি বিশেষজ্ঞ হলেও বর্তমানে রাজধানীর শ্যামলীতে যক্ষ্মা হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত। ছেলের জন্য ঢাকায় থাকতে হবে, তাই ক্যারিয়ারের দিকে মন দেওয়া সম্ভব হয়নি।’

ফেসবুক পোস্টে সাকলায়েন রাসেল লিখেছেন, ‘জীবন বেশ জটিল হয়ে পড়ল তখন...উচ্চতর ডিগ্রির জন্য রিমান্ডে আমার পড়ালেখা...পরীক্ষকদের স্বভাবসুলভ দমন...কীভাবে ডিগ্রি নেব, মিডিয়া সামলাব, সার্জন হব...জীবন সামলাব...সব মিলে একধরনের বিভীষিকায় আমি।’

তিন বছর বয়সে আরিজকে বিশেষ স্কুল প্রয়াসে ভর্তি করা হয়। মায়ের সঙ্গে প্রথম দিন স্কুলে গিয়েছিল। আরিজের মা ছেলের শার্টের ‘স্পেশাল স্কুল’–এর লোগোটা ধরে কেঁদেছেন সেদিন। আর বাবার চাওয়া ছিল, ‘ছেলে জানবে সে একজন মানুষ, পেটে ক্ষুধা লাগলে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসবে, নিজের কাপড়টা নিজেই পরতে পারবে, ও জানবে লজ্জা কী জিনিস, ও চিনবে এই মানুষটা ওর আপন, চেনা, উনি অচেনা।’

আরিজের পাঁচ বছর বয়স পার হলে আরিজের মায়ের পোস্টিং হয় মানিকগঞ্জে। ঢাকা থেকে যাওয়া–আসা করতেন। ফলে ছেলে একটু বেশি সময় মাকে পেত। আর বাসায় আরিজের দাদি, ফুফু ছিলেন এবং এখনো আছেন আরিজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে। আরিজের ফুফু সুমাইয়া সিরাজী পুষ্টিবিদ এবং বিশেষ শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত ঢাকার প্রয়াস স্কুলে।

সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‌‘যে কথা বলতে পারে না, সে–ও ইশারা দিয়ে নিজের চাহিদা বোঝাতে পারে। তবে আরিজ তো তা–ও পারে না। মাঝেমধ্যে কিছু একটার বায়না ধরে, কিন্তু বোঝাতে পারে না কিছুতেই, আমরাও বুঝি না, এটা এনে দিই, ওটা এনে দিই, থামে না আরিজ। নিজের মাথায় নিজেই আঘাত করে। নিরুপায় আমরা তখন ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করি।’

সাকলায়েন রাসেল জানালেন, একবার কয়েক মিনিট চোখের আড়ালেই আরিজ ঘটিয়েছিল ভয়াবহ ঘটনা। বিছানার চাদর ছিঁড়ে তা দিয়েই গলায় ফাঁস দিয়ে দিয়েছিল। হয়তো ইউটিউব দেখে গলায় ফাঁস লাগিয়েছিল বা টাই বানাতে গিয়েছিল। আরিজের দাদি ঘরে গিয়ে আরিজকে উদ্ধার করেছিলেন। ফসকা গেরো না হওয়ায় বেঁচে যায় সে। স্কুলে গিয়ে কপাল ফাটিয়ে ফেলা বা অন্য ঘটনা তো আছেই।

সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‘আরিজের গলায় ফাঁস লাগানোর ঘটনায় ও বেঁচে গেলে পরে মনে হয়েছে, তবু কিছু তো একটা করার চেষ্টা করেছে ছেলেটা। একবার আরিজকে থাপ্পড় দিই। আমার মা খুব রাগ করেছিলেন এ জন্য। তবে আমি দেখলাম, থাপ্পড় দেওয়ায় আরিজ একটু রিঅ্যাক্ট করল। মনে হলো ব্যথা পেয়েছে। এতেই মনে হয়েছে ও তো বিরক্তি প্রকাশ করতে পারল, ব্যথা পেল। আরিজদের গল্পগুলো এমনই।’

বাবা সাকলায়েন আরও বলেন, ‘আমার মনে হয় আরিজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। মান-অভিমান নেই। ওরা নিজেরা শতভাগ সুখী হলেও অসুখে ভোগে শুধু তার আপনেরা।’

বাংলাদেশ ভাসকুলার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সাকলায়েন রাসেল বললেন, একসময় ছেলের বিষয়টি মেনে নিতে পারতেন না তিনি। তখন অনেক কান্নাকাটি করতেন। তবে এখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আরিজের নামে গড়ে তুলেছেন আরিজ ফাউন্ডেশন। রংপুরের নিজেদের বাড়ির বিভিন্ন ঘরে বেঞ্চ পেতে রাখা হয়েছে।

রংপুরে আরিজ ফাউন্ডেশনে বড় হচ্ছে অসহায় শিশুরা।
ছবি:  সংগৃহীত

এটিই এখন আরিজ ফাউন্ডেশনের স্কুল। এলাকার হিন্দুপাড়াসহ অন্যান্য এলাকার অসহায় শিশুরা প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এ স্কুলে পড়ে। ১৩২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২০ জনই পড়ছে বিনা মূল্যে। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে হেলথ ক্যাম্পের আয়োজন করা, কিডনি রোগীদের সহায়তা, দুস্থ ব্যক্তিদের খাবার দেওয়াসহ অন্য কাজগুলো নিয়মিত করা হচ্ছে। আর কাজগুলোর ৯৯ শতাংশ খরচই বহন করছেন সাকলায়েন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

বেসরকারি একটি টেলিভিশনে খবর পাঠক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন সাকলায়েন রাসেল। তিনি বলেন, ‘আমাদের আরিজ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না। কিন্তু তার নামের ফাউন্ডেশনের সহায়তায় অন্য শিশুরা ভবিষ্যতে কিছু হতে পারলে এটাই আমাদের জন্য অনেক পাওয়া।’

অটিস্টিক শিশুরা প্রায়ই হারিয়ে যায়। তাই সাকলায়েন রাসেল এদের জন্য বিশেষ কোনো ঘড়ি কেনার কথা ভাবছেন, যে ঘড়িতে শিশুটির পরিচয় দেওয়া থাকবে। সাদাছড়ি দেখলে যেমন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সবাই বুঝতে পারে, তেমনি এই ঘড়ি দেখে যাতে অটিস্টিক শিশুদের চেনা যায়, তেমন কিছু করতে চাইছেন।

সাকলায়েন রাসেল বলেন,‌ ‘অটিস্টিক শিশুদের বেশির ভাগের শারীরিক কোনো সমস্যা না থাকায় চট করে কেউ বুঝতে পারে না তাদের কোনো সমস্যা আছে।’ একসময় আরিজকে আমরা ভয় পেতাম। এখন চারপাশের মানুষকে ভয় পাই। আরিজ হয়তো হাঁটার সময় কারও হাত ধরল, সে ছেলে না মেয়ে সে বোধ তো ওর নেই। এই বিষয়টিকে সবাই ভালোভাবে মেনে নেবে না।’

অন্য বাবা–মায়েদের মতো, আরিজের মা–বাবারও এখন একটাই চিন্তা—তাঁরা যখন থাকবেন না, তখন আরিজকে কে দেখে রাখবে? এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তাঁদের। এ প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা।