বিধবাদের তালিকায় পুরুষ, টাকা নয়ছয়, কাজে লাগেনি প্রশিক্ষণ

দুস্থ ও পিছিয়ে পড়াদের প্রশিক্ষণে ব্যয় ৫০৩ কোটি টাকা। নানাভাবে এসব প্রকল্প বাগিয়ে অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ।

ছবি: সংগৃহীত

বাড়ির আঙিনায় ‘গ্রিনহাউসে’ কীভাবে সবজি চাষ করা যায়, তার প্রশিক্ষণ দিতে সরকারের কাছ থেকে ৪৯ কোটি টাকা নিয়েছিল প্রগতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা। কথা ছিল, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তাঁরা পাবেন ৩০ হাজার টাকা দামের একটি করে গ্রিনহাউস। তাতে সবজি চাষ করে নারীরা স্বাবলম্বী হবেন।

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ী ইউনিয়নের সালেহা বেগম ছিলেন এই প্রকল্পের সুফলভোগীর তালিকায়। গ্রিনহাউসে সবজি চাষ কেমন হচ্ছে, তা দেখতে গত ৩১ মে যাই তাঁর বাড়িতে। দেখা গেল, বাড়ির আঙিনায় কোনো গ্রিনহাউস নেই। সালেহা বেগম বিধবা বা স্বামী নিগৃহীত নন, তাঁর স্বামী রমজান আলী কৃষিকাজের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। তাঁদের পরিবার গ্রামে সচ্ছল বলেই পরিচিত।

সালেহা প্রথম আলোকে বলেন, বছরখানেক আগে তিনি গ্রিনহাউসের ওপরে সাত দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তাঁর স্বামীও একই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। দুজনে তিন হাজার টাকা করে পান। টাকা দেওয়া হবে জেনেই তাঁরা প্রশিক্ষণে গিয়েছিলেন। তবে গ্রিনহাউস পাননি।

গ্রিন হাউসের ওপর প্রশিক্ষণ পান লালমনিরহাটের আদিতমারি উপজেলার রমজান আলী ও তাঁর স্ত্রী সালেহা বেগম। নিয়ম অনুযায়ী তাদের প্রশিক্ষণ পাওয়ার কথা নয়। এই পরিবার স্বচ্ছল।
ছবি: প্রথম আলো

গ্রিনহাউস না দেওয়ার এই ঘটনা সরকারি-বেসরকারি (জিও-এনজিও) যৌথ উদ্যোগে প্রশিক্ষণসংক্রান্ত প্রকল্পে অনিয়মের একটি উদাহরণ। করোনাকালে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি ও স্বাবলম্বী করে তোলার নামে এমন ২১টি প্রকল্পে সমাজসেবা অধিদপ্তর ৫০৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পের কাজ শেষ, ৮টির কাজ চলছে। তবে শেষের পথে।

তিন মাস ধরে পাঁচটি প্রকল্প নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান ও সুফলভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পের অনেক ক্ষেত্রেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। প্রকল্পগুলোতে দেওয়া স্বল্পমেয়াদি ও নামকাওয়াস্তে প্রশিক্ষণ কাজে লাগেনি বলে স্বীকার করেছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই। কোনো কোনো এনজিও বাছাইয়ে অভিজ্ঞতার শর্তও মানা হয়নি। কোনো কোনো প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি)।

প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করেছে বিভিন্ন এনজিও। এসব এনজিওর কোনো কোনোটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, সাবেক আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, চলচ্চিত্রের অভিনেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ কেউ বলেছেন, খাতিরের কারণে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তারপর ইচ্ছেমতো অনিয়ম করা হয়েছে।

২১টি প্রকল্পের ৭টিই একক অথবা যৌথভাবে গেছে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের নির্বাচনী এলাকা লালমনিরহাটের আদিতমারী ও কালীগঞ্জ উপজেলায়। জামালপুর ও গোপালগঞ্জে বাস্তবায়িত হয়েছে তিনটি করে। প্রকল্পগুলোতে অনিয়মের অভিযোগ মানতে নারাজ সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। তিনি গত ১৪ জুন নিজ দপ্তরে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অনিয়মের অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। কেউ যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য দেন, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কেউ এক মাস, কেউ তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণ খুব একটা কাজে আসছে না।
সত্যজিৎ কর্মকার, পরিকল্পনাসচিব

অনিয়মের গ্রিনহাউস

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় বুলবুলি খাতুনকে দেওয়া গ্রিনহাউসের সরঞ্জাম পড়ে আছে ঘরের কোনায়। এই প্রতিবেদক গেলে তিনি তা খুলে দেখান
ছবি: প্রথম আলো

শীতপ্রধান দেশগুলোতে যখন বরফ পড়ে, তখন গ্রিনহাউসে সবজি চাষ করা হয়। গ্রিনহাউস মূলত কাচ অথবা পলিমারের মতো উপকরণে তৈরি স্বচ্ছ একটি ঘর, যেখানে আলো প্রবেশ করতে পারে। তবে তাপ বেরিয়ে যেতে পারে না।

বাংলাদেশে সবজি চাষে এই প্রযুক্তি দেওয়ার কথা বলে সরকারের কাছ থেকে টাকা নেয় প্রগতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (পিএসইউএস)। এর চেয়ারম্যান সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব আতিকুর রহমান। তিনি গত ২১ জুন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরিকালে বিদেশ সফরে গিয়ে তিনি গ্রিনহাউস দেখেছেন। সেখান থেকেই গ্রিনহাউস দেওয়ার চিন্তা এসেছে।

আতিকুর বলেন, গ্রিনহাউস প্রকল্প অনুমোদনের পর তিনি এক বছর এনজিওটির চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। পরে পারিবারিক কারণে আর থাকতে পারেননি।

তবে প্রগতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক রাহাত খান গত ২২ জুন প্রথম আলোকে বলেন, আতিকুর এখনো তাঁদের চেয়ারম্যান।

যে প্রকল্পের আওতায় গ্রিনহাউস দেওয়ার কথা, তার নাম ‘টেকসই গ্রিনহাউস প্রযুক্তি ব্যবহার ও উন্নত কৃষি উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে করোনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রশমন’। মেয়াদ ২০২১ থেকে ২০২৩।

এই বাক্সে করেই গ্রিন হাউসের সরঞ্জাম আসে
ছবি: প্রথম আলো

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে চার জেলায়—রাজশাহী, জামালপুর, লালমনিরহাট ও যশোরে। প্রথম আলো লালমনিরহাট ও জামালপুরে প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছে। সুফলভোগী হিসেবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া তালিকায় থাকা ৩১ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের একজন শুধু গ্রিনহাউস পেয়েছেন। তবে ব্যবহার করেন না। ২১ দিনের জায়গায় প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৭ দিন করে। বিধবা বা স্বামী নিগৃহীত নারীদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও প্রশিক্ষণার্থীদের তালিকায় শিক্ষার্থী ও সচ্ছল ব্যক্তির পাশাপাশি পুরুষও রয়েছেন।

গত ৩০ মে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাকের কাছে গেলে তিনি একজন সুফলভোগীর নাম দেন। তিনি বুলবুলি খাতুন, কালীগঞ্জের বাসিন্দা। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি গ্রিনহাউসের সরঞ্জামের বাক্সটি তখন পর্যন্ত খুলেও দেখেননি।

বাকিরা কেন গ্রিনহাউস পাননি, জানতে চাইলে এই প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারা পায়নি, আপনি আমাকে নাম দেন। আমি ব্যবস্থা নেব।’

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রকল্পের অনিয়মের বিষয়ের প্রথম আলোর খোঁজখবর করা নিয়ে সম্প্রতি সমাজসেবা অধিদপ্তরে অনানুষ্ঠানিক এক অনলাইন বৈঠকে আলোচনা হয়। এরপর গত শনিবার কালীগঞ্জের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ডেকে গ্রিনহাউস দেওয়া হয়েছে, যাঁরা এক বছর আগে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। তবে সর্বশেষ গতকাল সোমবার আদিতমারীর সাতজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা গ্রিনহাউস পাননি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, লালমনিরহাটে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা তিন হাজার টাকা করে পেলেও জামালপুরে দেওয়া হয়েছে এক হাজার টাকা করে। এ বিষয়ে ওই এনজিওর জামালপুরের সমন্বয়ক শাহীনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নির্দেশ অনুযায়ী এ কাজ করেছিলেন। এ সময় তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একজন মুখ্য সচিবের ছোট ভাই বলে পরিচয় দেন।

শুধু প্রশিক্ষণ, অনুদানে ফাঁকি

‘দুস্থ, বিধবা, বেকার, প্রতিবন্ধী, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে টেকসই প্রশিক্ষণ’ নামের আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলায়। এ প্রকল্পে খরচ হয় ২৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ছয় হাজার মানুষকে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র (সুক) নামের একটি এনজিও। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল সেলাই, ফ্যাশন ডিজাইনিং, ব্লক-বাটিক, খাবার তৈরি ও কম্পিউটার ব্যবহার শেখানোর মাধ্যমে দুই জেলায় দক্ষ ও উপার্জনক্ষম স্বাবলম্বী জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা।

সুনামগঞ্জের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের এককালীন সাড়ে তিন হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগই তা পাননি। জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার নয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ইয়াসমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকা পরে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাইনি।’

বিষয়টি সত্য বলে জানান জগন্নাথপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা বিলাল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো টাকার বিষয়ে কিছুই জানি না।’

নথিপত্রে প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা সুকের কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি বাড়িতে। গত ২১ জুন বাড়িটিতে গেলে নিরাপত্তাকর্মী আইয়ুব আলী বলেন, সুক এক মাসের ভাড়া না দিয়ে পালিয়েছে। সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের কাছে অনেক মানুষ টাকা চাইতে আসত।

আমরা তো টাকার বিষয়ে কিছুই জানি না
জগন্নাথপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা বিলাল হোসেন

জাকির হোসেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে এড়িয়ে যান। পরে যতবারই ফোন করা হয়েছে, তিনি একই আচরণ করেছেন। সরকারি নথিতে সুকের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম দেওয়া আছে সাবেক বিদ্যুৎ-সচিব সুলতান আহমেদের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাঁরা একবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আমি সাড়া দিইনি।’

সুককে এই প্রশিক্ষণের কাজ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায়। এতে বলা হয়, সুক শর্ত পূরণ করেনি। তারপরও সুককে ২৩ কোটি টাকার এই কাজ দেওয়া হয়।

চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাঁরা একবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আমি সাড়া দিইনি।
সাবেক বিদ্যুৎ-সচিব সুলতান আহমেদ

হিজড়াদের প্রশিক্ষণ ‘কাজে লাগেনি’

হিজড়া জনগোষ্ঠী।
প্রথম আলো প্রতীকী ছবি

আটটি বিভাগের হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বহুমুখী প্রশিক্ষণ শিরোনামে একটি প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০১৮ সালে। ব্যয় বরাদ্দ ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কথা ছিল, হিজড়াদের রূপচর্চা, পরিচ্ছন্নতা, পোশাক ও জুতার কাজ, নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করা হবে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ঢাকা, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জ, রাজশাহী, বরিশাল, পটুয়াখালী, লালমনিরহাট, খুলনা ও ময়মনসিংহে ছয় হাজার হিজড়াকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবি করেছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রি-থিংক।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে লালমনিরহাট, সুনামগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই সব জেলায় হিজড়াদের প্রশিক্ষণের কথা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা কার্যালয় জানে না। গত ২৯ মে লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ ও জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, রি-থিংক লালমনিরহাটে হিজড়াদের কোনো প্রশিক্ষণ দেয়নি।

লালমনিরহাটে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০০ জন হিজড়াকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে রি-থিংক পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। অবশ্য জেলার হিজড়াদের একজন নেতা লিমন প্রথম আলোকে বলেন, লালমনিরহাটে ৫০ জনের বেশি হিজড়া নেই।

রি-থিংকের দাবি, সুনামগঞ্জে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ৩০০ জন হিজড়াকে। সুনামগঞ্জ জেলা হিজড়া কল্যাণ সমিতির সভাপতি সুমনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩০০ জন পাইত কই, আমরা তো আছিই দেড় শ জনের মতো। তারা প্রশিক্ষণ দিছে কয় ৩০০ জনরে। ইতা মিছা কথা।’

নোয়াখালীতেও একই চিত্র। এদিকে হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া এই প্রকল্প নিয়ে আইএমইডি গত বছর মে মাসে এক প্রতিবেদনে বলেছে, যে পাঁচটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সেসব কাজে একজন হিজড়াকেও পাওয়া যায়নি।

রি-থিংকের সভাপতি লুনা মারজান প্রথম আলোকে বলেন, হিজড়ারা ভাসমান। তাঁর সংস্থা একটি জেলায় প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অন্য জেলা থেকেও হিজড়াদের নিয়ে এসেছে। স্থানীয় প্রশাসনের না জানার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য হলো, বিষয়টি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।

হিজড়াদের কর্মসংস্থানের জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা যথাযথ নয় বলে মনে করেন লুনা মারজান। তাঁর দাবি, এই প্রকল্প ছিল তাঁর জন্য একটি বাজে অভিজ্ঞতা। এ জন্য তিনি বরাদ্দের শেষ দুটি কিস্তি নেননি, যা মোট বরাদ্দের প্রায় ৫০ শতাংশ হবে।

উল্লেখ্য, বরাদ্দ ছিল প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

২১ দিনের বদলে ৭ দিন প্রশিক্ষণ

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মিজানুর রহমান ও ওবায়দুল ইসলাম গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ পান মাত্র সাত দিনের। এই প্রশিক্ষণ তাঁদের কাজে আসেনি। এখন দুজন রাজমিস্ত্রির কাজ করেন
ছবি: প্রথম আলো

২০২১ সালে ‘অনগ্রসর ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন’ শিরোনামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়, যার ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে লালমনিরহাট, জামালপুর, পটুয়াখালী ও ভোলায়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।

প্রকল্পের আওতায় ৭ হাজার ৩০০ জনকে কম্পিউটার ও গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। সরকারের নথিতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ২১ দিন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে গ্লোবাল রুরাল এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (জিআরইএস)।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের তালিকা নিয়ে এ প্রতিবেদক গত ৩১ মে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার ইউনিয়নে যায়। তালিকায় থাকা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২১ দিন নয়, তাঁরা ৭ দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এত কম সময়ে তিনি গাড়ি চালানো শিখতে পারেননি। তিনি এখন রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেওয়া কেউই গাড়িচালকের পেশায় যাননি।

হিজড়াদের কর্মসংস্থানের জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা যথাযথ নয় বলে মনে করেন লুনা মারজান। তাঁর দাবি, এই প্রকল্প ছিল তাঁর জন্য একটি বাজে অভিজ্ঞতা। এ জন্য তিনি বরাদ্দের শেষ দুটি কিস্তি নেননি, যা মোট বরাদ্দের প্রায় ৫০ শতাংশ হবে। উল্লেখ্য, বরাদ্দ ছিল প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

প্রশিক্ষণ কোনো কাজে লাগেনি বলে জানান ওবায়দুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, হারাধন রায়, নিশরাত জাহান ও নিরঞ্জন মোহন্তসহ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন ব্যক্তি।

প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা স্বপন কুমার হালদার স্বীকার করেন যে স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে লাভ হয় না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা বিভিন্ন সভায় আমি নিজেও বলেছি।’

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এনজিও জিআরইএসের চেয়ারম্যান শামীমুল হক। অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প এলাকায় তাঁর তেমন যাওয়া হয়নি। তিনি খবর নেবেন। এ সময় তিনি জানান, তিনি নিজে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা। তাঁর ভাই প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব।

তাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, অথচ জানেনই না

‘লালমনিরহাট জেলার অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিবিধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটির ব্যয় ২৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। কম্পিউটার চালানো, খাবার তৈরির মতো প্রশিক্ষণের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে পুষ্প বাংলাদেশ নামের একটি এনজিও। মেয়াদ ২০২০ থেকে ২০২১।

প্রকল্পের সুফলভোগী হিসেবে দেখানো ব্যক্তিদের বেশ কয়েকজন বলেছেন, প্রশিক্ষণ, ব্যাগ, খাতা, কলম, যাতায়াত ভাতা ও নগদ এককালীন ১৫ হাজার টাকা সহায়তা—কোনোটিই তাঁরা পাননি। যেমন লালমনিরহাটের আদিতমারী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিক ও লালমনিরহাট আদর্শ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসানের নাম আছে তালিকায়। তাঁরা দুজনই বলেছেন, বিষয়টির কিছুই তাঁরা জানেন না।

আবার, কেউ কেউ বলেছেন, প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তবে টাকা পাননি। এ নিয়ে প্রকল্পের পরিচালক এম এ মতিন ও পুষ্প বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক নিশাত জাহান পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। এম এ মতিনের ভাষ্য, প্রশিক্ষণার্থীদের টাকা দেওয়াসহ সবকিছু ছিল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার অধীনে। অন্যদিকে নিশাত জাহানের দাবি, তাঁরা শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। টাকা দেওয়া তাঁদের দায়িত্ব ছিল না।

‘আপনাকে চিনি না’

মুঠোফোন মেরামত, গাড়ি চালনা শেখানোর মতো একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে হিউম্যান কনসার্নড নামের একটি এনজিও। এটির চেয়ারম্যান শেখ মুন্নি এবং কো-চেয়ারম্যান চলচ্চিত্র অভিনেতা ড্যানি সিডাক। ব্যয় বরাদ্দ ৯ কোটি টাকা। মেয়াদ ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।

সমাজকল্যাণসচিব জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে গত ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় এই প্রকল্পের ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, যেসব উপজেলায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হয়নি। এদিকে চারটি উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয়ে কথা বলে জানা যায়, সেখানে কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি।

হিউম্যান কনসার্নডের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি বাড়ির। গত ২১ জুন বাড়িটিতে গেলে নিরাপত্তাপ্রহরী ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি আবাসিক। শেখ মুন্নী পঞ্চমতলায় থাকেন। তিনি কানাডায় গেছেন। উল্লেখ্য, শেখ মুন্নী কানাডা যুব মহিলা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বলে ফেসবুকে নিজের পরিচয় উল্লেখ করেন।

ড্যানি সিডাকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদকের নাম-পরিচয় শুনে ‘আপনাকে চিনি না’ বলে ফোন কেটে দেন।

প্রকল্প অনুমোদনে যে কৌশল

প্রশিক্ষণসংক্রান্ত এসব প্রকল্প অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) ওঠেনি। কারণ, ৫০ কোটি টাকার নিচে ব্যয়ের প্রকল্প পরিকল্পনামন্ত্রীই অনুমোদন দিতে পারেন। করোনাকালে ‘লকডাউনের’ মধ্যে অনলাইনে পিইসি সভা করে প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, যেসব এনজিও প্রকল্প পেয়েছে, তাদের বেশির ভাগের চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদক অথবা মূল ব্যক্তি সরকারের কোনো কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ। তাঁদের মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাগিয়েছেন।

যেমন ফরিদপুরে করোনার প্রেক্ষাপটে কর্মহীন জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণের নামে প্রায় সাড়ে ২৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে গত ২৫ জুন পিইসি সভা হয়। সভার নথিতে দেখা যায়, প্রকল্পটি প্রক্রিয়া করতে একজন মন্ত্রীর লিখিত ও মৌখিক নির্দেশনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এসব প্রশিক্ষণ প্রকল্প যে কাজে আসে না, তা স্বীকার করেছেন পরিকল্পনাসচিব সত্যজিৎ কর্মকার। গত ১৭ মে নিজ দপ্তরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের ২৩টি মন্ত্রণালয় এখন প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছে। কেউ তিন দিন, কেউ এক মাস, কেউ তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণ খুব একটা কাজে আসছে না। সে কারণে সরকার চাইছে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) মাধ্যমে সব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

‘যোগসাজশ তৈরি হচ্ছে’

করোনাকালে নেওয়া প্রকল্পগুলোর সুফল কী, কতজনের কর্মসংস্থান হয়েছে, তার কোনো মূল্যায়ন নেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে। এর মধ্যেই আরও কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গত ১৫ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, দেশে সংস্কৃতি এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের তুলনায় সুবিধা অর্জনের বিষয়টিতে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত যাঁরা যুক্ত, তাঁদের সঙ্গে স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজশ তৈরি হচ্ছে। তিনি মনে করেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের এসব প্রকল্প পর্যালোচনা ও নিরীক্ষা করা দরকার।