অবকাশের পর আনন্দ ও অঙ্গীকারের জীবন

ঈদ, নববর্ষের ছুটি শেষে লঞ্চে ঢাকায় ফিরছেন মানুষ। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল।ছবি: প্রথম আলো

দীর্ঘ ছুটির পরে আবার শুরু হলো কর্মব্যস্ত নিয়মিত জীবন। যেমন তেমন ছুটি নয়—ঈদ, পয়লা বৈশাখ আর এই দুইয়ের মধ্যিখানে হাইফেনের মতো শনিবারের ছুটি মিলিয়ে পাঁচ দিনের টানা অবকাশ। দৈনিক পত্রিকাগুলোর ছুটি ছিল আরও এক দিন বেশি। সে কথা পরে হবে। কী বলব একে? মরূদ্যান পার হয়ে পরিব্যাপ্ত মরুভূমিতে পা রাখা? কিন্তু ভেবে দেখুন তো, আপনার আছে কেবলই অখণ্ড অবকাশ-কোনো কাজ নেই, দায়িত্ব নেই, নেই কোনো কিছু সম্পন্ন করার তাগিদ; কেমন হতো সেই জীবন? একঘেয়ে, একঘেয়ে এবং একঘেয়ে। কাজ আছে বলেই অবকাশ এত মধুর, এত আনন্দময়। রাতের অন্ধকার পটভূমির কারণেই প্রভাতের কোমল সূর্যকিরণে আমাদের মনের স্নান হয়।

এতগুলো দিনের দীর্ঘ ছুটির হদিস আমাদের সাম্প্রতিক জীবনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছয়-ছয়টা দিন যে কোনো দৈনিক পত্রিকাই বের হলো না, বাংলাদেশে এ এক অকল্পনীয় ও অভূতপূর্ব ঘটনা। এর কোনো অতীত নজির নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংবাদপত্রশিল্প এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সামনে হাজির হয়েছে ডিজিটাল জগতের এক নতুন বাস্তবতা। সেখানে ক্রমাগত বড় হচ্ছে তথ্য পাওয়ার পরিসর। আর নবীন প্রজন্ম সাবলীলভাবে বেড়ে উঠছে তারই মধ্যে। এমনকি সমাজের জ্যেষ্ঠ সদস্যরাও ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন তাতে।

এতগুলো দিনের দীর্ঘ ছুটির হদিস আমাদের সাম্প্রতিক জীবনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছয়-ছয়টা দিন যে কোনো দৈনিক পত্রিকাই বের হলো না, বাংলাদেশে এ এক অকল্পনীয় ও অভূতপূর্ব ঘটনা। এর কোনো অতীত নজির নেই।

তবু এত কিছুর পর অবকাশ তো অবকাশই। এক অবকাশে আবার দুই উৎসব। ঈদ আর পয়লা বৈশাখ। যেকোনো উৎসবেরই মূল বাণী ভেদ পার হয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগের। তারপরও একেক উৎসবের একেকটা যেন রং থাকে। ঈদ-উৎসবের আনন্দ মূলত পরিবার, বন্ধু আর নিকটজনকে ঘিরে। আর নববর্ষের উৎসব সামাজিক। এই দুই উৎসব যে পরপর এল, তা যেন আমাদের নানা রকমের যৌথতার মূল্যবোধকে আমাদের একটা তোড়ার মধ্যে ধরিয়ে দিয়ে গেল; দাগ কেটে দিয়ে গেল আমাদের মনে।

পরিবার আর স্বজনদের সঙ্গে ঈদের উৎসব করতে করতে আমরা এসে পৌঁছালাম বাংলা নববর্ষের আনন্দে। দেশে নানা অঞ্চলে বসল মেলা। নানা জেলার নানা কোণে আমাদের কারুশিল্পীরা তাঁদের তৈরি করা কারুপণ্যের সম্ভার নিয়ে বসলেন। সেসব কারুশিল্পে বাংলার সৃষ্টিশীল সৌন্দর্য আমাদের চোখকে নতুন করে তুলল।

নববর্ষকে বরণ করতে রাজধানীও পিছিয়ে থাকেনি। সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে হাজারো মানুষ এসেছে আলপনা আঁকতে। মানুষ এসেছিল সপরিবার। শাহবাগে বেরিয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা এখন বিশ্ব-ঐতিহ্যেরও অন্তর্গত।

অবকাশের পরে আমরা যখন কর্মে ভরা দিনগুলোতে ফিরছি, এসব আনন্দ আর অঙ্গীকার নিশ্চয়ই ছাপ রেখে যাবে আমাদের জীবনে।

আর ছিল গানে গানে ছায়ানটের বর্ষবরণ। ষাটের দশকে বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার গনগনে রাজনৈতিক আবহে, ১৯৬৭ সাল থেকে, ছায়ানট শুরু করেছিল বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাদে আর কখনোই তা বন্ধ থাকেনি, এমনকি ২০০১ সালের অনুষ্ঠানে জঙ্গিদের বোমা হামলার পরও না। এবার সেটা অনুষ্ঠিত হলো সমাজের অসহিষ্ণুতা থেকে বেরোনোর অঙ্গীকার নিয়ে।

দীর্ঘ এই অবকাশের পরে আমরা যখন কর্মে ভরা দিনগুলোতে ফিরছি, এসব আনন্দ আর অঙ্গীকার নিশ্চয়ই ছাপ রেখে যাবে আমাদের জীবনে।