ব্যয় কমাতে নতুন প্রকল্পে লাগাম

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চিঠি দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নেওয়া নিরুৎসাহিত করেছে। তাই প্রকল্প ফেরত পাঠাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।

সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫টি খননযন্ত্র বা ড্রেজার কেনার উদ্যোগ নিয়েছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে একটি প্রকল্প তৈরি করে তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল পরিকল্পনা কমিশনে। অবশ্য কমিশন প্রকল্পটি ফেরত পাঠিয়েছে।

কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় অঙ্কের প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিস্থিতি নেই। বিদেশি কোনো তহবিল পাওয়া গেলে প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।

এটির পাশাপাশি আরও কিছু প্রকল্প ফেরত পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। কোনো কোনো প্রকল্প এখন অনুমোদন না দিয়ে ফেলে রাখা হচ্ছে। আবার নতুন প্রকল্প পাঠাতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে নতুন প্রকল্পে লাগাম টানছে সরকার।

এসব প্রকল্প নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে পরিকল্পনা কমিশন থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আপাতত অনুমোদন দেওয়া হবে না, এটা সরাসরি বলা হয়নি।
আবু মো. মহিউদ্দিন কাদেরী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা শাখা)

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলছেন, সরকারের ব্যয় কমানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে নতুন প্রকল্প অনুমোদনে এই রক্ষণশীলতার নীতি নেওয়া হয়েছে। এর আগে গত ১৩ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনকে দেওয়া এক চিঠিতে নতুন প্রকল্প অনুমোদন নিরুৎসাহিত করতে বলা হয়। চিঠিটির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে সব মন্ত্রণালয়ের সচিবদেরও।

চিঠিতে বলা হয়, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছাড়া অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদনে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে যথাযথভাবে প্রকল্প প্রস্তাবকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। তবে চিঠিতে চলমান প্রকল্পগুলোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, এখন যেসব প্রকল্প পুরোনো ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এখন সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নতুন প্রকল্প অনুমোদনের গুরুত্ব পাবে।

যেসব প্রকল্পে লাগাম

বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া, দেশে আমদানি বৃদ্ধি, প্রবাসী আয় কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমা এবং রাজস্ব আয়ে ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বিভিন্ন খাতে ব্যয় সাশ্রয় করছে। সারা দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রকল্প অনুমোদনেও লাগাম টানা হলো।

এখন যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তাতে নতুন অবকাঠামো এখন প্রয়োজন নেই। নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ঠিকই আছে।
মোস্তাফিজুর রহমান, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)

পরিকল্পনা কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখন ভবন নির্মাণ, ড্রেজিং ও ড্রেজার কেনাসংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদন না দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। উদ্ভাবন ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত প্রকল্পও অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। কোনো প্রকল্পে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ থাকলে তা বাদ দেওয়া হচ্ছে।

মোট কয়টি প্রকল্প ফেরত পাঠানো হয়েছে বা অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না, তার কোনো তালিকা করেনি পরিকল্পনা কমিশন। তবে কমিশনের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে অন্তত ১০টি প্রকল্পের কথা জানা যায়, যা ফেরত পাঠানো অথবা অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, সংখ্যাটি অনেক বেশি হবে। এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় মূলত পুরোনো প্রকল্পের সংশোধনী অনুমোদন বেশি দেওয়া হচ্ছে।

যেসব প্রকল্প অনুমোদন পাচ্ছে না তার একটি হলো জিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদ–নদী খনন। ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেটি কমিশনে পড়ে আছে, একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য ওঠানো হচ্ছে না।

সূত্র জানায়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ দেশের সব কটি উপজেলায় এলইডি স্ক্রিন বসানোর একটি প্রকল্প নিয়েছিল। ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩২ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার করা। প্রকল্পটিও অনুমোদন পাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্বাভাবিক সময়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রকল্প দ্রুত একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হতো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) অন্য সংস্থার কিছু নতুন প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে না কমিশন। গ্রামে রাস্তাঘাট প্রশস্ত করার পাশাপাশি গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণের কিছু প্রকল্পও ফেরত পাঠানো হয়েছে অথবা অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে রাজশাহী বিভাগে গ্রামীণ সড়ক প্রশস্তকরণ, চট্টগ্রাম বিভাগের গ্রামীণ সড়ক প্রশস্তকরণ, মাগুরা ও নড়াইল জেলার সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা শাখা) আবু মো. মহিউদ্দিন কাদেরী প্রথম আলোকে বলেন, এসব প্রকল্প নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে পরিকল্পনা কমিশন থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আপাতত অনুমোদন দেওয়া হবে না, এটা সরাসরি বলা হয়নি।

বরাদ্দে কাটছাঁট ৬৩৬ প্রকল্পে

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ব্যয়েও কাটছাঁট করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চলমান প্রকল্পগুলোকে এ, বি ও সি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। ৬৪৬টি প্রকল্প রাখা হয়েছে এ শ্রেণিতে। এগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে। বরাদ্দে কোনো কাটছাঁট করা হবে না।

বি শ্রেণিতে রাখা হয়েছে ৬৩৬টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয়ের সরকারি (জিওবি) অংশের ২৫ শতাংশ অর্থ কাটা হবে। আর সি শ্রেণিতে থাকা ৯০টি প্রকল্পে কোনো অর্থ ছাড় দেওয়া হবে না।

চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার ২ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দে কাটছাঁটের মাধ্যমে ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে বলে আশা করছে সরকার। উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট নিয়ে দুই ধরনের অভিমত রয়েছে। প্রথমত, সরকারের ব্যয় কমালে তা বাজারের চাহিদা ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যখন মন্দাভাব তৈরি হয়, তখন সরকারের ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতি চাঙা করার পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদেরা।

দ্বিতীয়ত, সাময়িক সময়ের জন্য ব্যয় সাশ্রয়ের বিকল্প থাকে না। তখন অনুন্নয়ন ব্যয় কমাতেই বেশি জোর দেওয়া উচিত। সরকার এখন অনুন্নয়ন ব্যয় কমানোর কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। উন্নয়ন ব্যয় কমানোর চেষ্টাও করছে।

সার্বিক বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তাতে নতুন অবকাঠামো এখন প্রয়োজন নেই। নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ঠিকই আছে। তিনি বলেন, চলমান প্রকল্পগুলোর ব্যয় পর্যালোচনা করা উচিত। কেন একটি প্রকল্পে এতবার ব্যয় বাড়ে, সেখানেও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

উল্লেখ্য, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে বারবার প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর প্রবণতা দেশে রয়েছে।