উন্নয়ন নেই, বাড়ছে করের বোঝা

মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর চার বছরে সরকারি কোনো  প্রকল্পই পায়নি বরিশাল সিটি। উন্নয়ন বরাদ্দও কমছে।

  • করের পরিমাণ আগের তুলনায় ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

  • অর্থের অভাবে উন্নয়নকাজ হয় না। মাঝপথে বন্ধ হয়ে আছে নির্মাণকাজও।

বরিশাল সিটি করপোরেশন

নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ৮২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের ১১টিই এই প্রকল্পের অর্থ পেয়েছে। বাদ পড়েছে শুধু বরিশাল সিটি করপোরেশন। শুধু এই প্রকল্প নয়, বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর চার বছরের আমলে সরকারি কোনো প্রকল্পই পায়নি বরিশাল সিটি। কমেছে উন্নয়ন বরাদ্দও। নগরের প্রায় ৮০ শতাংশ সড়ক ব্যবহারের অনুপযোগী। সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হলেও নগরবাসীর ওপর বেড়েছে করের বোঝা।

সাদিক আবদুল্লাহ ২০১৮ সালের অক্টোবরে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন। তাঁর আমলে প্রতিবছর প্রস্তাবিত বাজেটে আয়ের বেশির ভাগ উৎসই দেখানো হয় সরকারি অনুদান, প্রকল্প ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সহায়তা। কিন্তু শেষে বরাদ্দ মেলে না। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা কাগজে-কলমে থাকে, বাস্তবায়ন হয় না।

বরিশাল সিটির দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে স্থানীয় সরকার বিভাগের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) ফলাফলেও। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে এপিএ বাস্তবায়নে সবার নিচে অবস্থান বরিশাল সিটির।

বরিশাল সিটির মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। বরিশালবাসীর প্রত্যাশা ছিল, সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র হলে নগরের চেহারা বদলে দেবেন। কিন্তু চার বছরে একটি প্রকল্পও মেলেনি। অথচ প্রায় একই সময়ে সিলেট সিটির মেয়রের দায়িত্ব নেন বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি এ সময়ে চারটি প্রকল্পে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন।

গত নির্বাচনে বাসদ-দলীয় মেয়র প্রার্থী মনীষা চক্রবর্তী বলেন, সিটি করপোরেশন নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির বদলে কর বাড়াতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু সেই অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি নাগরিকদের কাছে অস্পষ্ট।

আয়ের বড় অংশ খরচ বেতন-ভাতায়

করপোরেশন সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির আয়ের বড় অংশ চলে যায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। কোনো প্রকল্প না পাওয়ায় ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ কমতে থাকায় গৃহ করসহ সব ধরনের কর বৃদ্ধি করে আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন।

হাটবাজার, গৃহকর, ট্রেড লাইসেন্স ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে করপোরেশনের বার্ষিক গড় আয় ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকা। তবে কর বাড়ানোর পর গত অর্থবছরে এই আয় বেড়ে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা হয়। এর মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস ও অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে নগরীর খাল পুনঃখনন, আধুনিক বিপণিবিতান ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণসহ ১৯টি মধ্যমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা, জলাশয় ভরাট বন্ধ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনাসহ ১০টি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার উল্লেখ করা হয়। অর্থাভাবে কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি।

বাজেট ও বরাদ্দ কমছে

বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রতিবছরই বাজেটের আকার কমছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৪৮ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২০ কোটি টাকা কমিয়ে ৪২৮ কোটি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন।

এডিপি ও বিশেষ থোক বরাদ্দের পরিমাণও কমছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত দুই কিস্তিতে ৩ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

থমকে আছে উন্নয়নকাজ

নগরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০০ আসনবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু মিলনায়তন, বরিশাল মহানগরের দুই প্রান্তের প্রবেশমুখ দুটি ফটকের নির্মাণকাজ বছরের পর বছর পড়ে আছে। অর্থের সংস্থান হয় না বলে এখন কাজ পুরোপুরি বন্ধ।

নগরে পানি সরবরাহের জন্য ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পলাশপুর ও রূপাতলীতে দুটি পানি শোধনাগারের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৫ সালের জুনে। কিন্তু বিদ্যুৎ-সংযোগের অভাবে শোধনাগার দুটি এক দিনের জন্যও চালু করা যায়নি।

বেহাল সড়ক, সেবাব্যবস্থা

৪৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বরিশাল সিটির আওতায় মোট সড়ক রয়েছে ৫১৩ কিলোমিটার। নিয়মিত সংস্কার না হওয়ায় ৮০ ভাগ সড়ক চলাচলের অনুপযোগী। এ ছাড়া পানি সরবরাহের জন্য ২৮৯ কিলোমিটার পাইপলাইন, সড়কবাতির জন্য রয়েছে ২৮০ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন। এসব লাইনে সড়কবাতি রয়েছে ১৫ হাজার। অর্থসংকটে এসব সেবাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। টাকার অভাবে অনেক জায়গায় জ্বলে না সড়কবাতি।

বরিশাল সিটির কাছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ওজোপাডিকোর। প্রায় ১০ বছর ধরে নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হচ্ছে না।

নাগরিকদের কাঁধে করের বোঝা

নাগরিকদের সেবা দিতে না পারলেও কর বাড়িয়েছে করপোরেশন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর আগের তুলনায় ১০ গুণ বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে বর্ধিত কর নেওয়া শুরু হয়।

 সিঅ্যান্ডবি রোডের এক বাড়ির মালিক বলেন, তাঁর চারতলা বাড়ির আগে গৃহকর ছিল চার হাজার টাকা। এখন তাঁকে ৩৫ হাজার ৭০০ টাকা দিতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের বার্ষিক গৃহকর ছিল ২১ লাখ টাকা। দুই বছর আগে নতুন কর ধার্য হয় ৫৪ লাখ টাকা। আবেদন করে তা ৫১ লাখ করা হয়। দুই অর্থবছর করও পরিশোধ করা হয়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত ৩০ লাখ টাকা কর পুনর্নির্ধারণ করা হয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে গত মাসে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর দপ্তরে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।

আগামী বছরের মাঝামাঝি বর্তমান পরিষদের মেয়াদ শেষ হবে। কিন্তু এই পরিষদের সময়ে উন্নয়ন বঞ্চনার চিত্র বদলাবে—এমনটা আশা আর করতে পারছেন না নগরবাসী।

সুশাসনের জন্য নাগরিকর (সুজন) নগর কামটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, নগরবাসী উচ্চ হারে কর দিচ্ছেন, কিন্তু ন্যূনতম নাগরিক সেবা মিলছে না। গত চার বছরে সরকারি প্রকল্প কেন পাওয়া গেল না, সেটি নগরবাসীর কাছে তুলে ধরা উচিত। এটি নগরবাসীর জানার অধিকার রয়েছে।