দোষারোপ নয়, দুই পক্ষের সরাসরি আলোচনায় জোর

ডোনাল্ড লু বলেছেন, কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা বাদ দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাজ নয়। ক্ষমতায় কে যাবে, সেটা বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করে দেবে।

ডোনাল্ড লু

দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরে এসে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় জোর দিয়ে গেছেন। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুরোপুরি নিখুঁত নয়। এতে দুর্বলতা আছে। সমস্যার বিষয়ে কথা বললে তা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য না দিয়ে, খোলামনে কথা বলে সমস্যার সমাধান করাটাই শ্রেয়।

ঢাকায় ডোনাল্ড লুর সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমন মনোভাবের কথা জানা গেছে।

মো. শহীদুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মতো মৌলিক মূল্যবোধগুলো অটুট রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডোনাল্ড লুর সফরকে বৃহত্তর বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
মো. শহীদুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরের সময় বলে গেছেন, কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলে একে অন্যকে দোষারোপ করলে তাতে সমাধান আসবে না। সমস্যা নিয়ে জনসমক্ষে বা গণমাধ্যমে কথা বলার আগে দুই পক্ষের (ঢাকা ও ওয়াশিংটন) সরাসরি খোলামনে আলোচনা করাটাই ভালো। তা না হলে একে অন্যকে দোষারোপের ফলে দুই পক্ষের তিক্ততাই বাড়বে। সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করাটাই যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার।

আরও পড়ুন

গত শনিবার সন্ধ্যায় দুই দিনের ঢাকা সফরে আসেন ডোনাল্ড লু। এ সফরে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদা মতবিনিময় করেছেন। এর মধ্যে তিনি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন। তিনি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং শ্রমিকনেতাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন।

গত রোববার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু
ছবি প্রথম আলো

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত তিনটি আলাদা আলোচনা এবং ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় অনুষ্ঠিত নৈশভোজে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কথা জানান ডোনাল্ড লু। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব আলোচনায় তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক হোক, এটাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাওয়ার সঙ্গে ওয়াশিংটনের প্রত্যাশার মিল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবে এই প্রত্যাশার প্রতিফল চায়। গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে যে এখানে ভুল ধারণা আছে, সেটিও তিনি উল্লেখ করেছেন। ডোনাল্ড লু স্পষ্ট করে বলেছেন, এক দলকে সরিয়ে অন্য দলকে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাবে, এটা ভুল ধারণা। ক্ষমতায় কে যাবে, সেটা বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করে দেবে।

আরও পড়ুন

ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরের বিভিন্ন আলোচনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দীর্ঘদিনের অগ্রাধিকার গণতন্ত্র, সুশাসন এবং মানবাধিকারের ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। এর পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে যে ওয়াশিংটন গুরুত্ব দেয়, সেটিও তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলে। গত এক বছরের বেশি সময়ে যেকোনো আলোচনাতেই বাংলাদেশের মনোযোগ ছিল, এই নিষেধাজ্ঞা যেন প্রত্যাহার করা হয়। নতুন করে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা যাতে না আসে, সে বিষয়টিও ডোনাল্ড লুর সঙ্গে আলোচনার তোলার কথা সরকার ভেবেছিল। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যা কমে যাওয়ায় ডোনাল্ড লু অকপটে র‌্যাবের প্রশংসা করে গেছেন।

বাংলাদেশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, র‌্যাব নিয়ে ডোনাল্ড লু প্রশংসার কেন্দ্রে ছিল মানবাধিকার সুরক্ষা। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়ে তিনি মূলত সুশাসনের ওপরই জোর দিয়ে গেছেন।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ডোনাল্ড লু বেশ ‘খোলামনে’ এবং ‘আন্তরিক’ আলোচনার ওপর জোর দিয়েছেন। আবার শাহীনবাগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ঘিরে অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ভিন্নমত আর শ্রমিক অধিকার সুরক্ষায় ঘাটতি নিয়ে অকপটে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন। সামগ্রিকভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ঢাকা সফরের সময় ওয়াশিংটনের ‘এমন নিবিড় বন্ধুত্বের বার্তা’ বাংলাদেশের অনেক কর্মকর্তাকে অবাক করেছে।

কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ঢাকায় আসার আগে ডোনাল্ড লুর দিল্লি সফরটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে অতীতে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে কাজের অভিজ্ঞতা থাকা ডোনাল্ড লুর ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা অজানা নয়। এই অঞ্চলকে ঘিরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং এখানে স্থিতিশীলতা বজায় রাখাকে গুরুত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে বাংলাদেশের নির্বাচনের এক বছর আগে দিল্লি থেকে কোনো বার্তা আত্মস্থ করাটা ওয়াশিংটনের জন্য অস্বাভাবিক নয়।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও দিল্লি ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু ফেলো অধ্যাপক মো. শহীদুল হক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের আড়াই শ বছরের ইতিহাসে পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মতো মৌলিক মূল্যবোধগুলো অগ্রাধিকার হিসেবে অটুট রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডোনাল্ড লুর সফরকে বৃহত্তর বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

অধ্যাপক মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক যে মেরুকরণ গড়ে উঠতে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশকে নিজেদের পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এমন একটা সময়ে অতিরিক্ত সমালোচনার কারণে বাংলাদেশ যাতে চীন কিংবা রাশিয়া বলয়ের অংশ না হয়, সেটিও নিশ্চয় যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনায় রাখছে।