উৎপাদন বাড়লেও দেশে দুধের ঘাটতি 

একজন মানুষের দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা দরকার হলেও দেশে দিনে মাথাপিছু দুধ উৎপাদিত হয় ২০৮ মিলিলিটার। 

দেশে গত এক দশকে দুধের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। তারপরও দেশে দুধের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। মাথাপিছু দুধপানও কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে কম। আবার দিন দিন বাড়ছে দুধের দাম।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে নতুন প্রবণতা হচ্ছে, তরল দুধের চেয়ে দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এই বাড়তি চাহিদা মেটাতে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া উচিত।

দুধের উৎপাদন বেড়েছে

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে দুধ উৎপাদন হতো প্রায় ৫০ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। পরের তিন অর্থবছরে তা বেড়ে ৭২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি হয়। তবে ২০১৬–১৭ অর্থবছরে উৎপাদন এক লাফে ২০ লাখ মেট্রিক টন বেড়ে হয় ৯২ লাখ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। তবে এতে দেশে দুধের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। কারণ, দেশে বছরে চাহিদা ১ কোটি ৫৬ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী, একজন মানুষের দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা দরকার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে দিনে মাথাপিছু দুধ উৎপাদিত হয় ২০৮ মিলিলিটার। দুই বছর আগে এই পরিমাণ ছিল ১৭৫ মিলিলিটার।

অবশ্য দুধের উৎপাদন ও মাথাপিছু দুধপানের এই সরকারি উপাত্ত নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন, উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি যথাযথ নয়। 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আশিকুল ইসলাম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, সন্দেহ নেই, দেশে গত এক দশকে দুধের উৎপাদন বেড়েছে। তবে উৎপাদনের সরকারি হিসাব কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি আরও যথাযথ হওয়া উচিত। 

দুধের দাম বাড়ছে 

রাজধানীর মনিপুরিপাড়ার দোকানি তাজুল ইসলাম প্যাকেটজাত পাস্তুরিত দুধ বিক্রি করেন। তিনি বলছিলেন, দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি খানিকটা কমেছে। গত বছর এ সময়ে তিনি দিনে ২৫ লিটার দুধ বিক্রি করতেন। এখন ২০ থেকে ২২ লিটার বিক্রি হয়। তাঁর মতে, অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ দুধ কম কেনেন। 

দেশে ২০১৮ সালে এক লিটার পাস্তুরিত তরল দুধের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। ২০২১ সালেও দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। এখন দাম ৯০ টাকা। পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিকেই দুধের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

বাংলাদেশে ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, এক লিটার দুধ উৎপাদনে যে ব্যয় হয়, তার ৭০ শতাংশই যায় পশুখাদ্যে। এর বাইরে শ্রমমূল্য ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ও রয়েছে।

বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খামার পর্যায়ে পরিবহন খরচসহ তাঁরা ৫৫ টাকা ৩০ পয়সা টাকা লিটারে দুধ কেনেন। অন্যান্য কোম্পানি প্রতি লিটার কেনে ৪৭ টাকায়। বিনা মূল্যে ঘাসের বীজ, চিকিৎসকের খরচ, কোনো খামারি ১০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন করলে প্রতি লিটার এক টাকা বাড়তিসহ নানা প্রণোদনা দেওয়া হয়।

শেখ নাদির দাবি করেন, ‘সব খরচ মিটিয়ে প্রতি লিটার দুধে আমাদের লাভ ৫৫ পয়সা।’ 

বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হারুন অর রশীদ গরুর খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির একটি চিত্র তুলে ধরে বলেন, বছরখানেক আগেও ৩৭ কেজির এক বস্তা ভুসির দাম ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এখন দাম দুই হাজার টাকা।

গবেষকেরা বলছেন, দেশে দুধের উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে গাভির কম উৎপাদনক্ষমতা একটি কারণ। অধ্যাপক হারুন বলছিলেন, দেশে একটি গাভি গড়ে বছরের ৩০৫ দিনে দৈনিক ৮ থেকে ১০ লিটার দুধ দেয়। অথচ শীতপ্রধান দেশে একটি গাভি ২২ থেকে ৩০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়।

অধ্যাপক হারুন বলেন, ‘দেশের গরুগুলো অনেক সময় মানসম্মত খাবার পায় না। এ জন্য এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কম। দেশীয় ঘাসে প্রোটিনের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। উন্নত ঘাসের জন্য বিকল্প চাষাবাদে অনেক খামারি আগ্রহী হন না। 

দুগ্ধজাত পণ্য ও গুঁড়া দুধের চাহিদা বাড়ছে 

দেশে তরল দুধের পাশাপাশি বাড়ছে দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা। বাংলাদেশে ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলছিলেন, ‘আমরা বাসাবাড়িতে জরিপ চালিয়ে দেখেছি, বয়স্কদের মধ্যে দুধ পানের অভ্যাস আছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সীদের মধ্যে দুগ্ধজাত নানা পণ্য যেমন মিষ্টি, দই, লাবাং খাওয়ার প্রবণতা বেশি।

মিল্ক ভিটা প্রতিদিন খামারিদের কাছ থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে। এর মধ্যে গুঁড়া দুধ তৈরিতে ১ লাখ ৩০ হাজার লিটার লাগে। বাকি ১ লাখ লিটারের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ হাজার লিটার পাস্তুরিত তরল দুধ করা হয়। বাকিটা দিয়ে তৈরি হয় নানা পণ্য।

মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগে মিল্ক ভিটা তিন–চারটি দুগ্ধজাত পণ্য বানাত। এখন ২২টি পণ্য বানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে আইসক্রিম, চকোবার, কেক, লাবাং ইত্যাদি। দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে আমাদের এদিকে নজর দিতে হচ্ছে।

করণীয় কী

ডেইরি খাতের সহায়তা এবং মানসম্মত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য তৈরিতে বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য গত ১০ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০২৩’–এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই আইন কার্যকর করা হলে খামার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়বে। খাদ্যনিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাবে।

দুগ্ধ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে সরকারি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে এই বোর্ডের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বিষয়েও তাঁরা তাগিদ দিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা ডেইরি খাতের উন্নয়নে মানবসম্পদ তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন। 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আশিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডেইরি শিল্পের জন্য প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। নইলে বিশ্ববাজারের সঙ্গে আমরা পারব না।’