প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ সুফিউর রহমানকে প্রায় দুই মাস আগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগের ৬৬ দিনেও তিনি কাজে যোগ দেননি। ফলে গত ২০ এপ্রিল তাঁকে যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটি কি এখনো কার্যকর আছে, নাকি বাতিল করা হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
অবশ্য গত বুধবারও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় অধ্যাপক ইউনূসের বিশেষ সহকারীর তালিকায় সুফিউর রহমানের নামটি ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগের পর সুফিউর রহমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাঁর নির্দেশনা নিয়ে কাজে যোগ দেবেন। কিন্তু নিয়োগের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা কাতার সফরে যাওয়ায় তিনি সে সময় দেখা করতে পারেননি। প্রধান উপদেষ্টা কাতার ও ভ্যাটিকান সিটি সফরের পর দেশে ফিরলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাননি সুফিউর রহমান।
ওই কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা অনানুষ্ঠানিকভাবে জেনেছেন যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে সুফিউর রহমান আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিচ্ছেন না।
সুফিউর রহমানকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর নাম এখনো সরকারি ওয়েবসাইটে রয়েছে। তাঁর বর্তমান স্ট্যাটাস কী, জানতে চাইলে গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি এখানে এই পদে যোগ দেননি। এটুকু আমি বলতে পারি।’
গত বছরের অক্টোবরে সুফিউর রহমানকে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগের পরিকল্পনা ছিল সরকারের। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের পরামর্শে জ্যেষ্ঠ সচিব পদমর্যাদায় ওই নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় ছিল। এমনকি অক্টোবরের শুরুর দিকে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের পরপরই সুফিউর রহমানের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রচারণা হয়। বলা হয়, সুফিউর রহমান জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর ছিলেন। ওই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একাংশও সুফিউর রহমানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ই-মেইল চালাচালি করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত তাঁর ওই নিয়োগের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগের পর সুফিউর রহমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাঁর নির্দেশনা নিয়ে কাজে যোগ দেবেন। কিন্তু নিয়োগের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা কাতার সফরে যাওয়ায় তিনি সে সময় দেখা করতে পারেননি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গত ২০ এপ্রিলের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বিশেষ সহকারী হিসেবে সুফিউর রহমানকে নিয়োগ দিয়েছেন। রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ অনুযায়ী, উপদেষ্টাকে সহায়তার জন্য সুফিউর রহমানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করা হলো। বিশেষ সহকারী পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে সুফিউর রহমান প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
নিয়োগ পাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে জানতে সুফিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পরপরই প্রথমে সুফিউর রহমানের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একাংশের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে ‘মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করা’র ফলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের ক্ষমতা সংকুচিত হবে কি না, সেই প্রশ্ন ওঠে। বিশেষ করে ওই ঘোষণার ফলে সুফিউর রহমানের দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরিচালিত হবে, নাকি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পরিচালিত হবে—এ বিষয় সামনে চলে আসে। কারণ, এখন পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত পাঁচজনই নিজেদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বসে দায়িত্ব পালন করছেন।
জানা গেছে, সুফিউর রহমানের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশের আগে তৌহিদ হোসেন জানতেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বসে দাপ্তরিক কাজ করবেন সুফিউর রহমান। ফলে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন দেখে পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও কিছুটা অবাক হয়েছিলেন।
নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পরপরই জেনেভায় বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগ আমলে সুফিউর রহমানের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার প্রচার শুরু হয়। বলা হয়, তিনি জেনেভায় দায়িত্ব পালনের সময় বাংলাদেশের ভিন্নমতাবলম্বী ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ওই সময় মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আদিলুর রহমান খান (এখন শিল্প উপদেষ্টা) জেনেভায় বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নিলে তৎকালীন সরকারের হয়ে তাঁর (আদিলুর) বিরুদ্ধাচরণ করতেন সুফিউর রহমান। এ নিয়ে অব্যাহত প্রচারণার মুখে সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে প্রভাবশালী কয়েকজন এই নিয়োগের বিপক্ষে অবস্থান নেন।
জানা গেছে, সুফিউর রহমানের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশের আগে তৌহিদ হোসেন জানতেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বসে দাপ্তরিক কাজ করবেন সুফিউর রহমান। ফলে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন দেখে পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও কিছুটা অবাক হয়েছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্য এই প্রতিবেদককে জানান, প্রধান উপদেষ্টা কাতার থেকে ফেরার পর সুফিউর রহমানের যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে পিছু হটে অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকারের আরেকটি উচ্চপর্যায়ের সূত্র এই প্রতিবেদককে জানায়, গত ৭ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ ও শৃঙ্খলাবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সুফিউর রহমানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে এমন মত এসেছে যে সুফিউর রহমান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দিতে পারবেন না, এটা তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
অবশ্য খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈঠকের সিদ্ধান্ত কোনো এক অজানা কারণে সুফিউর রহমানকে এখনো জানানো হয়নি।
সাবেক কূটনীতিক সুফিউর রহমান ২০২৪ সালে অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি অস্ট্রেলিয়া ও মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সুফিউর রহমান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সে (এসআইপিজি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো হিসেবে কাজ করছেন।
নিয়োগ পাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে জানতে সুফিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।