ছবি আর কাপড়ে মাকে খুঁজছে অরিদ্র ও রুদ্র

দুই ছেলে ও স্বামীর সঙ্গে তৃষ্ণা রানী রায়
ছবি: সংগৃহীত

দেয়ালে টাঙানো ছবিটা যেন জীবন্ত। মায়ের ব্যবহৃত কাপড়, আয়না ও প্রসাধনী পড়ে আছে। হারমোনিয়াম আর সেলাই মেশিনটিও আছে আগের জায়গায়। এখন এসব শুধুই স্মৃতিচিহ্ন। কারণ, সব থাকলেও মা যে আর নেই। তাই ঘরজুড়ে এসব স্মৃতিচিহ্নেই মাকে খুঁজে ফিরছে অরিদ্র ও রুদ্র।

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র অরিদ্র রায়। বড় ভাই রুদ্র রায় উচ্চমাধ্যমিকের। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত সোমবার তাদের মা তৃষ্ণা রানী রায় (৩৯) মারা গেছেন। আজ বুধবার চট্টগ্রামের দক্ষিণ কাট্টলিতে তৃষ্ণা রানীর বাসায় কথা হলো তাঁর স্বামী ও দুই ছেলের সঙ্গে। মায়ের স্মৃতিই খুঁজে ফিরছে ছেলেরা।

রোববার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় অরিদ্রর। সেদিন ভোরেই তৃষ্ণা রানীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। মাকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য আবদার করেছিল অরিদ্র। কিন্তু অসুস্থ তৃষ্ণাকে নিয়ে বাড়ির সবাই ব্যস্ত থাকায় মায়ের সঙ্গে শেষ দেখাটা হয়নি তার।

অরিদ্রকে রোজ স্কুলে আনা–নেওয়া করতেন তার মা। এখন থেকে কে তাকে আনা-নেওয়া করবেন, বলতে পারছে না ১০ বছরের শিশুটি। মায়ের না থাকার কথা মনে হতেই চোখ ছলছল করে উঠল।

তৃষ্ণা রানী রায়
ছবি: সংগৃহীত

অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই মায়ের দেখভাল করছিল অরিদ্র। বলল, শুক্রবার তার মায়ের জ্বর আসে। ওষুধ খাওয়ালে শনিবার পুরো সুস্থও হন। পরদিন রোববার এক চিকিৎসকের কাছেও নেওয়া হয়। কিন্তু সোমবার ভোরে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে মাকে নেওয়া হয় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে।

সেখানে তৃষ্ণা রানীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে এদিন বিকেলেই নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখানেই রাত সাড়ে নয়টায় মৃত্যু হয় তাঁর। মায়ের মৃত্যু নিয়ে আক্ষেপ করে রুদ্র বলল, ‘মা আমাদের একটু সময় দিল না। খুব দ্রুত আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’

মুঠোফোনে মায়ের ছবি দেখাচ্ছে রুদ্র
ছবি: জুয়েল শীল

সোমবার বিকেলে ক্লিনিক থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়ার সময় মায়ের সঙ্গে শেষবার কথা হয় রুদ্রর। অ্যাম্বুলেন্সে মায়ের শিয়রের পাশে বসেছিল ছেলেটি। রুদ্র বলল, ‘তখনো মা জিজ্ঞেস করছিলেন, ভাত খেয়েছি কি না, অরিদ্র খেয়েছে কি না। নিজের কষ্ট চেপে রেখেছিলেন।’

মাকে দেখার জন্য হাসপাতালে যেতে চেয়েছিল জানিয়ে অরিদ্র বলল, ‘দুপুরে হাসপাতাল থেকে আমার এক দাদা বাসায় আসেন। তিনি আবার হাসপাতালে যাওয়ার সময় আমিও রাস্তা পর্যন্ত যাই যাতে আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু আমাকে পরে নিয়ে যাবেন বলে কৌশিকদা চলে যান।’

এটিই মায়ের সঙ্গে রুদ্রর তোলা শেষ ছবি
ছবি: সংগৃহীত

বলতে বলতে মাথা নিচু করল অরিদ্র। পাশে বসা রুদ্রর মাথায় হাত রাখল। তখন মুঠোফোনে মায়ের সঙ্গে তার স্মৃতিময় ছবিগুলোতে চোখ বোলাচ্ছিল রুদ্র। মাসখানেক আগে কাট্টলি সাগরপাড়ে গিয়ে মায়ের সঙ্গে তোলা একটি ছবি দেখিয়ে রুদ্র বলল, ‘এটাই মায়ের সঙ্গে আমার শেষ ছবি।’

পাশে দাওয়ায় বসেছেন তাদের বাবা রাজেন্দ্র প্রসাদ রায়। ছেলেদের পড়ালেখা বা খাওয়াদাওয়া, তেমন খোঁজখবর রাখতে হতো না জানিয়ে জানালেন, সবকিছু তৃষ্ণাই সামলে নিতেন। আকস্মিক স্ত্রীর এ বিদায়ে রাজেন্দ্র বুঝতে পারছেন না, পরবর্তী দিনগুলো কীভাবে কাটবে তাঁর ও দুই ছেলের।