স্বপ্ন যখন বাস্তবতা

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

গত শতকের সত্তরের দশকের আমার শৈশব দিনের কথা। রংপুর শহরে বসবাস। মেইন রোডটি ছিল পিচঢালা চকচকে কালো বর্ণের। তার দুই ধারে বড় বড় শাল, সেগুন, মেহগনি ও কড়ইগাছের শীতল ছায়ায় নিবিড় আলিঙ্গনে শামিয়ানা টাঙানো। দারুণ ছিমছাম নীরব নিস্তব্ধ আন্তরিকতায় মাখামাখি। সেখানে আমরা ১০-১২ জন মেয়ে। সারা দিন ঘুরে বেড়াতাম, ঠিকাদারপাড়া, লালবাগ, কারমাইকেল কলেজ, আবার কখনো গুপ্তপাড়া, শাপলা চত্বর, নূরপুর।

বিকেল হলেই উকিল দাদার পুকুরপাড়ে পুতুল খেলতাম। ছেলেপক্ষ বনাম মেয়েপক্ষ। মুকুল নামে আমার বয়সী একটা ছেলেও ছিল। তাকে আমরা তাড়াতে চাইতাম, কিন্তু সে কিছুতেই যেত না। খেলায় না নিলে পুতুল নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেত। মুকুল ছিল আমার বান্ধবী বেদনার ছোট ভাই।

ওকে আমরা ঘটক বানাতাম। দরজি চাচার দোকান থেকে টুকরা কাপড় এনে পুতুলের জামা-শাড়ি তৈরি করতাম। কুড়িয়ে পাওয়া পুঁতি দিয়ে মেয়ে পুতুলের গয়না তৈরি হতো।

আমাদের পাড়াটি যেমন মায়াময়, তেমনই আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল পড়শিরা। প্রায় প্রতিটি বাসা থেকে খাবারের বাটি আদান-প্রদান হতো। মজার কথা হলো, আমি যে বাসায় তরকারির বাটি নিয়ে যেতাম, সেখানে খাবার খেয়ে আসতাম। ভাবতাম এটাই বুঝি নিয়ম। না ছিল লজ্জা, না ছিল সংকোচ।

একদিন এপ্রিলের প্রথম দিন। এক বাটি বালু বাটিতে ঢেকে নিয়ে গিয়ে আমার হবু শাশুড়িমাকে দিয়েছিলাম। উনি বাটি খুলতেই এপ্রিল ফুল বলে হাততালি দিয়ে হেসে উঠেছিলাম। সবাই হাসাহাসি করছিলেন। উনি বালুর বাটি ধুয়ে মাংসের তরকারি দিয়েছিলেন। সেই কথা মনে পড়লে খুব অপরাধবোধ হয়। কেন অমনটি করেছিলাম? আমার শাশুড়িমা হওয়ার আগেই উনি জান্নাতবাসী হয়েছেন।

শৈশবের দিনগুলো পেরিয়ে কিশোরীবেলায় পৌঁছে ছেলেদের সঙ্গে সেভাবে আর মিশি না। কেননা, যে ছেলেগুলোর সঙ্গে ছোটবেলায় দাঁড়িয়াবান্ধা, ছি বুড়ি খেলতাম, সেই বন্ধুগুলোর চোখের ভাষা তখন পাল্টে গেছে। বয়ঃসন্ধিতে সেটাই হয়তোবা স্বাভাবিক। শুধু মুকুল আগের মতো। দেখা হলে কুশলাদি জানতে চায়। লেখাপড়া নিয়ে আলাপ হয়।

আমার বিয়ে হয়ে গেলে সংসার করতে ঢাকায় চলে আসি। রংপুরে গেলে সব বান্ধবী দেখা করতে আসে, তেমনি মুকুলও আসে। ও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

একবার অনেক দিন পর রংপুর এসেছি। জুমার নামাজ শেষে মুকুল আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। দেখে চমকে উঠি:

‘তোমার কী হয়েছে মুকুল? এমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছ কেন?’ মুখটাও ততধিক ফ্যাকাশে।

ম্লান হেসে মুকুল বলল, ‘বন্ধুরা মিলে বাণিজ্য মেলায় গিয়ে ফায়ার জাম্প দেখলাম, মৃত্যুকূপের মধ্যে মোটরসাইকেল চালানো দেখলাম। যাত্রা দেখার জন্য গিয়েছি, প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে না দেখে এক লোকের পা মাড়িয়ে দিই। তাকে সঙ্গে সঙ্গে সরি বলে দুঃখ প্রকাশ করি। কিন্তু লোকটা আমায় কষে থাপ্পড় দিল, এতে রেগে গিয়ে আমিও একটা থাপ্পড় দিই। তৎক্ষণাৎ লোকটির সাঙ্গপাঙ্গরা আমায় ধরে নিয়ে যায়, পিস্তল দেখে আমার বন্ধুরা পিছিয়ে যায়। ওরা ছোট্ট একটা অন্ধকার ঘরে সারা রাত আটকে রেখে বীভৎস রকমের টর্চার করে। আমি অচেতন হয়ে যাই। পরদিন ভোরে তারা আমাকে চিকলী বিলে ফেলে যায়। শুনেছি, লোকটা নেতা ছিল।’

মুকুলের চোখভরা টলটলে পানি। আমার দুই চোখ ভরা পানি। আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ও শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। মনে মনে আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করছি ওর দ্রুত সুস্থতার জন্য।

চলে আসি ঢাকায়। এক রাতে স্বপ্নে দেখি, মুকুল মারা গেছে। কাঁদতে থাকি, আমার স্বামীকে বললাম স্বপ্নের কথা। স্বামী বোঝালেন দুঃস্বপ্ন দেখেছ। আর স্বপ্ন তো স্বপ্নই, তাই না?

কয়েকটি দিন কেটে গেল। মাঝেমধ্যে স্বপ্নের কথাটা মনে হলে বুকের ভেতর কষ্টে চিন চিন করে ওঠে।

আমার ছোট বোন জবা চিঠি পাঠিয়েছে। বিস্তারিত কুশলাদি অনেক কিছু লিখেছে।

শেষ দুটি লাইন থেকে চোখ সরাতে পারছি না। লিখেছে, ‘আপু, একটা দুঃসংবাদ, গত পরশু রাতে মুকুল ভাই মারা গেছে।’ আমি অবাক বিস্ময়ে আমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে, সে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি হিসাব কষে দেখছি, আমি যেদিন স্বপ্ন দেখেছি, সেদিন মুকুল মারা গেছে। স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার এই মিলে যাওয়ার ব্যাখ্যা কী? আমায় এখনো ভাবায়।