বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা পাইয়ে দিতে ‘সরকারি চাপ’

  • পরিচয় কম্পিউটার কাউন্সিলের সেবা। পরিচালনা করে ডিজিকন। রাজস্বের বেশির ভাগ পায় তারা।

  • অপারেটররা নির্বাচন কমিশন থেকে জনপ্রতি ৫ টাকায় তথ্য যাচাই সেবা নেয়। পরিচয় চায় ১০ টাকা।

বিটিআরসি

‘পরিচয়’ নামের একটি সেবা থেকে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে গ্রাহক ফরম পূরণের জন্য বারবার চিঠি দেওয়া হচ্ছে মোবাইল অপারেটরদের। গ্রাহকদের এই তথ্য সংরক্ষণে অপারেটরদের তথ্যভান্ডারও তৈরি করতে হবে। তাতে থাকবে মানুষের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, মা-বাবার নাম, জন্ম তারিখ, ঠিকানা, লিঙ্গ পরিচয়, পেশা ও ছবি।

অবশ্য মোবাইল অপারেটররা এ ধরনের কোনো তথ্যভান্ডার তৈরিতে আগ্রহী নয়। তারা বলছে, আইন অনুযায়ী কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের তথ্যভান্ডার তৈরি করতে পারে না। গ্রাহকদের তথ্য তারা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডার থেকেই যাচাই করে।

‘পরিচয়’ নামের একটি সেবার কাছ থেকে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নিতে হবে মোবাইল অপারেটরদের। আগ্রহী নয় অপারেটররা।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সর্বশেষ গত ২৫ জানুয়ারি মোবাইল অপারেটরগুলোকে তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য চিঠি দেয়। চিঠিতে যে সেবা থেকে তথ্য নিতে বলা হয়, সেটি বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি)। বিসিসির ওই সেবা পরিচালনা করে ডিজিকন টেকনোলজিস নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সেবাটি থেকে আয়ের বড় অংশই ডিজিকন পায়।

অভিযোগ উঠেছে, ডিজিকনকে ব্যবসা পাইয়ে দিতেই তথ্যভান্ডার তৈরির চাপ দেওয়া হচ্ছে। মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য দিতে মোবাইল অপারেটরদের কাছে জনপ্রতি প্রায় ১০ টাকা দাবি করছে পরিচয়। আর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ থেকে অপারেটররা যাচাই সেবা পায় জনপ্রতি ৫ টাকায়।

বিটিআরসি তথ্যভান্ডারটি তৈরি করতে বলেছে অপরাধ দমনের কথা বলে। তাদের যুক্তি হলো, এক ব্যক্তি বিভিন্ন নামে একাধিক সিম ব্যবহার করে নানা অপরাধ করেন। তথ্যভান্ডার তৈরি হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সহজ হবে।

বিটিআরসি থেকে বলা হয়, অপারেটরদের তথ্যভান্ডারটি তৈরি করতে হবে না। কিন্তু গত ২৫ জানুয়ারি বিটিআরসি অপারেটরদের চিঠি দিয়ে মানুষের তথ্য নেওয়া এবং তা সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে।

বিটিআরসি গত ১৮ জানুয়ারি বিষয়টি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে একটি বৈঠক করে। সংস্থাটির সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের জন্য তাদের মোবাইল অপারেটরদের ওপর নির্ভর করতে হয় না। তখন বিটিআরসি থেকে বলা হয়, অপারেটরদের তথ্যভান্ডারটি তৈরি করতে হবে না। কিন্তু গত ২৫ জানুয়ারি বিটিআরসি অপারেটরদের চিঠি দিয়ে মানুষের তথ্য নেওয়া এবং তা সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ লিখিত বক্তব্যে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেছে, ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর কমিশন সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ‘ইলেকট্রনিক টেলিযোগাযোগ গ্রাহক নিবন্ধন ফরম অটোফিলকরণ’ বাস্তবায়নের জন্য মোবাইল অপারেটরদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর আরেক দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ জানুয়ারির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য সর্বশেষ চিঠির জবাবে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব গত ৩০ জানুয়ারি বিটিআরসিকে চিঠি দিয়ে বলেছে, ‘আমরা অবাক হচ্ছি এই কারণে যে বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়টি চিঠিতে প্রতিফলিত হয়নি।’

সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ বলছে, পরিচয় একটি ‘গেটওয়ে সার্ভার’, যা নির্বাচন কমিশনের জাতীয় তথ্যভান্ডারের সঙ্গে যুক্ত। এটি জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, মুঠোফোন নম্বর ও ছবি যাচাইয়ের সুবিধা দেয়।

‘পরিচয়ের’ পরিচয়

মুঠোফোনের সিম বিক্রির সময় এখন মোবাইল অপারেটরগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে তথ্য নেয়। তারা আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্যভান্ডারের মাধ্যমে। বিটিআরসি গত ২৫ জানুয়ারি অপারেটরদের চিঠিতে বলেছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরম পূরণ করতে হবে। মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নিতে হবে বিসিসির বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচারের (বিএনডিএ) মাধ্যমে। বিএনডিএর একটি সেবা হলো পরিচয়, যা ২০১৯ সালের জুলাই মাসে চালু হয়।

সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ বলছে, পরিচয় একটি ‘গেটওয়ে সার্ভার’, যা নির্বাচন কমিশনের জাতীয় তথ্যভান্ডারের সঙ্গে যুক্ত। এটি জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, মুঠোফোন নম্বর ও ছবি যাচাইয়ের সুবিধা দেয়। ভবিষ্যতে পাসপোর্ট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাইয়ের সুবিধাও এর আওতায় আসবে।

মানুষ যাতে সহজে সেবা নিতে পারেন, সে জন্যই তথ্য যাচাইয়ের আলাদা ব্যবস্থাটি করা হয়েছে। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান এর মাধ্যমে সহজে সেবা পাচ্ছে। তিনি বলেন, সব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই সেবাটি দেওয়া হচ্ছে।
জুনাইদ আহ্‌মেদ

পরিচয় জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত ২০০টির বেশি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানকে ১৯ কোটি তথ্য যাচাই সেবা দিয়েছে। পরিচয় সেবা পরিচালনাকারী ডিজিকন টেকনোলজিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহেদ শরীফ গত ১৮ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা শুধু কারিগরি সেবা দিয়ে থাকেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারে প্রবেশের সুযোগ নেই। তিনি জানান, পরিচয় কাজটি পেয়েছে সরাসরি ক্রয়প্রক্রিয়া বা ডিপিএম পদ্ধতিতে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বেশ কিছু সরকারি কাজ করেছে ডিজিকন। যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ব্যবস্থাপনার কাজ পেয়েছে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টেকসিটি বিডি। সেখানেও রাজস্বের বড় অংশ তারা পায়। আইসিটি বিভাগ ও এর অধীন সংস্থার বিভিন্ন প্রশিক্ষণের কাজ করেছে ডিজিকন।

পরিচয় থেকে তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার তৈরির বিষয়ে বিটিআরসি ও মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে দীর্ঘদিন চিঠি চালাচালি চলছিল। আর অপারেটররা নানা কারণ দেখিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছিল। তবে নতুন সরকারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক দায়িত্ব পাওয়ার পর বিষয়টি জোর পায়। দায়িত্ব নিয়েই তিনি বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য বলেন।

নির্বাচন কমিশন থাকতেও পরিচয় কেন, জানতে চাইলে জুনাইদ আহ্‌মেদ গত ১৮ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ যাতে সহজে সেবা নিতে পারেন, সে জন্যই তথ্য যাচাইয়ের আলাদা ব্যবস্থাটি করা হয়েছে। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান এর মাধ্যমে সহজে সেবা পাচ্ছে। তিনি বলেন, সব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই সেবাটি দেওয়া হচ্ছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যসম্পর্কিত কাজের দায়িত্ব দেওয়া প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার কোনো ব্যবসা নিজে করতে চায় না।

নির্বাচন কমিশন ও পরিচয়ের সেবার মধ্যে পার্থক্য হলো, পরিচয়ের কাছ থেকে ছবি যাচাইয়ের বাড়তি সেবা পাওয়া যায়।

রাজস্বের বড় অংশ পরিচয়ের

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরিচয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক তথ্য যাচাইয়ের বিনিময়ে ডিজিকন টেকনোলজিস আয়ের ৬০ শতাংশ পাবে এবং ২০ শতাংশ করে পাবে নির্বাচন কমিশন ও আইসিটি বিভাগ। তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরম পূরণ সেবার রাজস্বের ৮০ শতাংশ, ছবি যাচাইয়ের ৮৬ শতাংশ ও আঙুলের ছাপ (বায়োমেট্রিক) যাচাইয়ের জন্য ৯০ শতাংশ পাবে ডিজিকন।

ডিজিকনকে কেন সরাসরি ক্রয়প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা ছাড়া এই কাজ দেওয়া হয়েছিল, তা জানতে চাওয়া হয় বিসিসির তৎকালীন পরিচালক (ডেটা সেন্টার) তারেক এম বরকতউল্লাহর কাছে। তিনি বিএনডিএর দায়িত্ব ছিলেন। এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময়ে সরকারের অনুদান দিতে গিয়ে দেখা যায়, একই ব্যক্তির অনেকগুলো নম্বরে অনুদান চলে যাচ্ছে। সে সময় ডিজিকন বলেছিল, তারা যাচাই করে দিতে পারবে। তাই তাদের কাজ দেওয়া হয়েছিল।

সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে সরকারি ক্রয়ে স্বজনপ্রীতির সুযোগ থাকে। সরকারি কেনাকাটায় এ প্রক্রিয়া তাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করা হয় না। সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পরিচয়ের ক্ষেত্রে রাজস্ব ভাগাভাগির যে অনুপাত নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।

নির্বাচন কমিশন ও পরিচয়ের সেবার মধ্যে পার্থক্য হলো, পরিচয়ের কাছ থেকে ছবি যাচাইয়ের বাড়তি সেবা পাওয়া যায়।

নির্বাচন কমিশন কেন ছবি যাচাই সেবা দেয় না, জানতে চাইলে কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের সিস্টেম ম্যানেজার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আঙুলের ছাপ যাচাইয়ে ইউনিকনেস (অনন্যতা) আছে, কিন্তু ছবিতে সেটি নেই।

তথ্যপ্রযুক্তিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন চাইলেই ছবি যাচাইও যুক্ত করতে পারে। এটা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়; বরং সেবাটি দিলে তাদের আয় বাড়বে।

নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল তথ্য ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব একমাত্র সরকারের। কিছু কাজ বেসরকারি খাতে কোনোভাবেই দেওয়া উচিত নয়।
লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান

ব্যয় ‘বাড়বে’

মোবাইল অপারেটররা বলছে, পরিচয়ের কাছ থেকে সেবা নিতে তাদের বাড়তি খরচ হবে। আবার তথ্যভান্ডার তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণেও ব্যয় হবে, যা ব্যবসার ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। যদিও এটার কোনো প্রয়োজন নেই। খরচ শেষ পর্যন্ত গ্রাহকের ওপরই চাপবে। নির্বাচন কমিশন যে সেবা দেয়, একই ধরনের সেবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কেন নিতে হবে, সেই প্রশ্নও তুলছে তারা।

সার্বিক বিষয়ে টেলিযোগাযোগ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল তথ্য ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব একমাত্র সরকারের। কিছু কাজ বেসরকারি খাতে কোনোভাবেই দেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, জাতীয় তথ্যভান্ডার এখন নির্বাচন কমিশনের হাতে আছে। ভবিষ্যতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে যাবে। তথ্য যাচাইয়ের কাজে আইসিটি বিভাগ কেন আসবে।

আবু সাঈদ খান আরও বলেন, পরিচয় প্রতিষ্ঠাই সন্দেহজনক ও দুরভিসন্ধিমূলক। এখানে ব্যবসায়িক কায়েমি স্বার্থ জড়িত।