মন্দির-মণ্ডপে হামলা: দুই বছরেও বিচার শুরু হয়নি ৪২ মামলার
মন্দির-মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২০২১ সালে কুমিল্লায় ১২টি, নোয়াখালীতে ৩২টি, চাঁদপুরে ১০টিসহ মোট ৫৪টি মামলা হয়।
দুই বছর আগে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদীঘির পাড়ে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপ, মন্দির, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুরে করা ৫৪ মামলার মধ্যে ৪২টির বিচারকাজ এখনো শুরুই হয়নি।
এ অবস্থায় গত শুক্রবার কুমিল্লায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ মিছিলে ধাওয়া দিয়েছেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ঐক্য পরিষদের নেতারা। এদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনটি সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট, বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদ ও বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু ফোরাম এবারও দুর্গাপূজায় হামলার আশঙ্কা করছে। এ অবস্থায় আগামী শুক্রবার শুরু হচ্ছে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।
বিশেষ আইন করা না গেলে আসামিরা জামিন পেয়ে সাক্ষীদের হুমকি দেবেন। দ্রুত বিচারের আওতায় আনা না গেলে সাক্ষীরা আসবেন না, মামলাগুলো ঝুলে যাবে।রানা দাশগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
মামলার হালচাল
মন্দির-মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২০২১ সালে কুমিল্লায় ১২টি, নোয়াখালীতে ৩২টি, চাঁদপুরে ১০টিসহ মোট ৫৪টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৪২টি মামলার বিচারকাজ এখনো শুরুই হয়নি। চার্জ গঠন না হওয়া ৪২ মামলার মধ্যে কুমিল্লার ১১টি ও নোয়াখালীর মামলা আছে ৩১টি।
২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর বেলা দুইটায় কুমিল্লা নগরের মনোহরপুর রাজ রাজেশ্বরী কালীমন্দিরে ছিলেন দিলীপ দাস (৬১)। তখন মন্দিরের পাশের সড়ক দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন একদল লোক। ওই মিছিল থেকে মন্দিরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। মাথায় ইট লেগে গুরুতর জখম হন তিনি। ২১ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দিলীপ। এ ঘটনায় দিলীপের স্ত্রী রূপা দাস ২৪ অক্টোবর বাদী হয়ে কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলা করার প্রায় দুই বছর পার হচ্ছে, এখন পর্যন্ত ওই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। মামলার আসামিও শনাক্ত হয়নি।
কুমিল্লায় করা বাকি ১১টি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এসব মামলায় ৩৬৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে কুমিল্লার সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. জহিরুল ইসলাম সেলিম বলেন, ১২টি মামলার মধ্যে ১১টির অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিচারকাজ শুরু হয়নি। বেশির ভাগ মামলার আসামি গ্রেপ্তার হননি। ওই কারণে চার্জ গঠনে দেরি হচ্ছে।
দিলীপ দাসের স্ত্রী রূপা দাস বলেন, ‘এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে কষ্টের জীবন। এখন পর্যন্ত স্বামী হত্যা মামলার আসামি শনাক্ত হয়নি। মামলার চার্জশিটও হয়নি। এটা দুঃখজনক। পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে আমরা সর্বস্বান্ত।’
জানতে চাইলে পিবিআই কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘দিলীপ দাস হত্যা মামলার অভিযোগপত্র এখন পর্যন্ত দিতে পারিনি। এটির তদন্ত চলছে।’
২০২১ সালের ১৪ ও ১৫ অক্টোবর পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও দুই মৃত্যুর ঘটনায় নোয়াখালীতে ৩২টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে একটি ছাড়া বাকিগুলোর বিচারকাজ এখনো শুরু হয়নি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের অনেকেই জামিনে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
জেলা জজ আদালত ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৩২ মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আছেন ৬৪৫ জন। পুলিশ এ পর্যন্ত ৩৭০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। যাঁদের বেশির ভাগই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।
জেলা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গুলজার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় হওয়া ৩২টি মামলার সব কটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জেলা আদালতে বিচারের জন্য তিনটি মামলা স্থানান্তরিত হয়েছে। ওই তিন মামলার মধ্যে একটির চার্জ গঠন সম্পন্ন হয়েছে। বাকি দুটি মামলা চার্জ গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে।
কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বাজারে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। তখন হাজীগঞ্জ পৌর এলাকাসহ উপজেলার আশপাশে কয়েকটি মন্দির ও মণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। হাজীগঞ্জ বাজারে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ বাধলে পুলিশ গুলি চালায়। এ সময় ঘটনাস্থলে তিনজন, পরে হাসপাতালে দুজনের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনায় হাজীগঞ্জে করা ১০ মামলার সব কটির বিচারকাজ চলছে।
চাঁদপুরের সরকারি কৌঁসুলি রনজিৎ রায় চৌধুরী বলেন, হাজীগঞ্জের মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার প্রতিটি মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। খুব দ্রুতই এসব মামলার সাক্ষী গ্রহণ শেষে রায় দেবেন আদালত।
এ বছরের প্রস্তুতি
কুমিল্লার ১৭টি উপজেলা ও মহানগরে এবার ৮১৬টি পূজামণ্ডপে শারদীয় দুর্গোত্সব হবে। এ উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দল পূজামণ্ডপ পাহারায় থাকবে। গত বছর জেলার ৭৯৫টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার নগরের বিভিন্ন মন্দির ও পূজামণ্ডপ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও প্রতিমায় রংতুলির আঁচড় দেওয়া হচ্ছে। কোথাও প্যান্ডেল বানানোর কাজ চলছে।
নোয়াখালীতে এ বছর ১৮৫টি মণ্ডপ ও মন্দিরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। গত বছর পূজামণ্ডপ ছিল ১৭৯টি। সব কটি মণ্ডপেই এখন পূজার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে।
জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রতন কৃষ্ণ পাল প্রথম আলোকে বলেন, এবার গত বছরের তুলনায় আরও বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি চলছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি উপজেলা শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ করা হয়েছে।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ২৯টি মণ্ডপে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ আশ্রমের সন্যাসী স্বামীসেবা ময়ানন্দ বলেন, ‘হাজীগঞ্জে বিভিন্ন মন্দিরে হামলার ঘটনার পর থেকে আমরা আতঙ্কে থাকি। তবে ওই ঘটনার পর মন্দির এলাকায় আমাদের ছেলেদের দিয়ে রাতে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। পুলিশও টহল দেয়।’
দুই বছর আগে মণ্ডপে, মন্দিরে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় করা বেশির ভাগ মামলার বিচার শুরু না হওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এসব মামলার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বিদ্যমান আইনে নয়, এ জন্য তাঁরা সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের (মাইনরিটি প্রোটেকশন অ্যাক্ট) কথা বলছেন। বিশেষ আইন করা না গেলে আসামিরা জামিন পেয়ে সাক্ষীদের হুমকি দেবেন। দ্রুত বিচারের আওতায় আনা না গেলে সাক্ষীরা আসবেন না, মামলাগুলো ঝুলে যাবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন গাজীউল হক, কুমিল্লা; মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী ও আলম পলাশ, চাঁদপুর]