৫৪ কোটি টাকার জাহাজ অলস পড়ে নষ্ট হচ্ছে

সংস্থাটির কাছে সরকারের বকেয়ার পরিমাণ ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। দিন দিন বাড়ছে লোকসান।

বিআইডব্লিউটিসির কেনা এমভি মধুমতী ও এমভি বাঙালি জাহাজ দুটি এক বছর ধরে পড়ে আছে। সম্প্রতি রাজধানীর সদরঘাটের বাদামতলী ঘাটে
ছবি: প্রথম আলো

প্রায় সাত বছর আগে এমভি বাঙালি ও এমভি মধুমতী নামের দুটি যাত্রীবাহী জাহাজ কিনেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঋণ নিয়ে জাহাজ দুটি কিনতে সংস্থাটির খরচ হয় ৫৪ কোটি টাকা। এক বছর ধরে জাহাজ দুটি সদরঘাটের বাদামতলী ঘাটে অলস পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ইঞ্জিনসহ যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

জাহাজ দুটি কেনা হয়েছিল সেবাদান ও লাভের আশায়। এখন উল্টো প্রতিবছর লোকসান গুনতে হচ্ছে বিআইডব্লিউটিসিকে। ঋণের টাকা শোধও করতে পারছে না তারা।

ঢাকার যানজট কমিয়ে আনতে নৌপথে চালানোর জন্য আট বছর আগে ১২টি ওয়াটার বাস কিনেছিল বিআইডব্লিউটিসি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কেনা হয়েছিল এ যান। সব কটি ওয়াটার বাসই নষ্ট হয়ে গেছে। ঋণের টাকাও ওঠেনি।

‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের হিসাব মিলছে না। আমাদের হিসাব বলছে, তারা পাবে ৯০০ কোটি টাকার মতো।’
ফেরদৌস আলম, বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান

শুধু যাত্রীবাহী জাহাজ নয়, উপকূলীয় জাহাজ, ওয়াটার বাস, ফেরি থেকে আয় কমে গেছে সংস্থাটির। সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এখন দেনা পরিশোধ করতে পারছে না তারা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বিআইডব্লিউটিসির কাছে ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা পাবে সরকার। সংস্থাটি সে টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। যেটিকে ডেট সার্ভিস লায়াবিলিটি বা ডিএসএল বলা হয়। সাধারণত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব তহবিল থেকে ঋণ দিয়ে থাকে সরকার। ঋণ গ্রহণকারী সংস্থাগুলোকে ঋণের আসল ও কিস্তি সরকারকে পরিশোধ করতে হয়। সংস্থাগুলো থেকে এ ধরনের ঋণের আসল ও সুদ বাবদ আদায়যোগ্য অর্থকে ডেট সার্ভিস লায়াবিলিটি বা ডিএসএল বলা হয়।

ডিএসএল নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ে ত্রিপক্ষীয় সভা হয়। যেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় জানানো হয়, সংস্থাটির কাছে সরকারের ডিএসএল বাবদ বকেয়ার পরিমাণ ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা।

বিআইডব্লিউটিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংস্থাটিতে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নেই। যাত্রীবাহী জাহাজ, ফেরি, ওয়াটার বাস কেনাকাটায় যতটা মনোযোগ ছিল, এগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কেউ ততটা তৎপর নয়। পদ্মা সেতু চালুর পর তাদের আয় কমে গেছে, এটা ঠিক। কিন্তু বিকল্প নৌপথ বের করতে তৎপরতা দৃশ্যমান নয়।

বকেয়া ঋণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান ফেরদৌস আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের হিসাব মিলছে না। আমাদের হিসাব বলছে, তারা পাবে ৯০০ কোটি টাকার মতো।’ লোকসানের বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁদের বড় আয় ছিল মাওয়া ফেরিঘাট থেকে। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আয় কমে গেছে। খরচ রয়ে গেছে আগের মতোই।

লোকসানে এমভি বাঙালি ও এমভি মধুমতী

২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এমভি বাঙালি বিআইডব্লিউটিসির বহরে যুক্ত হয় ২০১৪ সালের মার্চে। সমপরিমাণ টাকায় ২০১৫ সালের মে মাসে কেনা হয় এমভি মধুমতী।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন বলছে, জাহাজ দুটিতে যাত্রী পরিবহন করে বছরে সাত কোটি টাকা করে লাভ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই উল্টো বছরে পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ৭৬ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ দুটি বানিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাজ দুটির লোকসানের কয়েকটি কারণের মধ্যে রয়েছে জেটি সদরঘাটের মূল টার্মিনাল থেকে অনেক দূরে, বাদামতলীতে। ফলে যাত্রীরা দূরে এসে জাহাজে উঠতে চান না। দ্বিতীয়ত, এ দুটি জাহাজ সম্পর্কে সাধারণ যাত্রীরা ততটা জানে না। এ ছাড়া পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী না মেলায় লোকসান কমাতে বসিয়ে রাখা হয়েছে জাহাজ দুটি।

বিআইডব্লিউটিসির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি নেওয়ার আগে সমীক্ষা করা হয়নি। পদ্মা সেতু চালু হলে দুটি জাহাজের কী হবে, তারও আগাম পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।

বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান ফেরদৌস আলম বলেন, ঢাকা–বরিশাল রুটে বেসরকারি লঞ্চমালিকেরাই যাত্রী পান না। আমাদের একটি লঞ্চে প্রতিবার যাতায়াতে তেল লাগে আট লাখ টাকার। সেখানে আয় হয় দুই লাখ টাকা। যাত্রী না পেলে এভাবে কত দিন ভর্তুকি দিয়ে চলা যায়?

গত এক দশকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঋণ নিয়ে যাত্রীবাহী জাহাজের পাশাপাশি উপকূলীয় যাত্রীবাহী জাহাজ, পন্টুন, কনটেইনারবাহী জাহাজ, ফেরি কিনেছে বিআইডব্লিউটিসি। সংস্থাটি থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত মোট ২৩টি ফেরি কেনা হয়েছে। তাতে খরচ হয়েছে ২১৩ কোটি টাকা। যাত্রীবাহী জাহাজ কেনা হয়েছে ২৪টি। তাতে ব্যয় হয় ১২০ কোটি টাকা। চারটি কার্গো কিনতে ব্যয় হয় ১৫২ কোটি টাকা।

বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে ২০২০ সালে অবসরে যান প্রণয় কান্তি বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে কী করা উচিত, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংস্থাটিতে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা প্রকট। সংস্থাটির উচিত, বেসরকারি খাত যেভাবে চলছে, সেভাবে চলার চেষ্টা করা। তাদের নিজেদের আয়ে নিজেদের চলতে হবে।

বাদামতলীতে অলস পড়ে আছে আরও তিনটি স্টিমার

এক বছরের বেশি সময় ধরে সদরঘাটের বাদামতলী ঘাটে আরও তিনটি স্টিমার অলস পড়ে আছে। সেগুলো হচ্ছে পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচা ও পিএস টার্ন। ব্রিটিশ আমলের তৈরি এসব নৌযান দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

দেশীয় ঐতিহ্য হিসেবে পিএস লেপচা ও পিএস টার্নকে বরিশাল ও চাঁদপুরে সংরক্ষণ করার কথা। কিন্তু বিআইডব্লিউটিসির গাফিলতির কারণে স্টিমারগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা হচ্ছে—এসব নৌযান বসিয়ে না রেখে সংরক্ষণ করতে, যাতে মানুষ দেখতে পারে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।

সম্প্রতি সদরঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ধুলার আস্তরণ পড়েছে স্টিমারগুলোর ওপর। সেখানে শ্রমিকেরা বসে গল্প করছেন। বিআইডব্লিউটিসির আওতায় পিএস অস্ট্রিচ নামে আরেকটি স্টিমার আছে। যেটি এখন ভাড়ায় চলছে।