২৪ জানুয়ারির গণহত্যা এরশাদের পতন অনিবার্য করে তুলেছিল

বিনা উসকানিতে মিছিলকারীদের দিকে টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছোঁড়ে পুলিশ (বাঁয়ে)। প্রাণভয়ে ছুটছে মানুষ। নিউ মার্কেট এলাকায়ছবি: সংগৃহীত

এথেলবার্ট গোমেজ। খুলশীতে একটি কোরীয় পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। বউকে নিয়ে থাকতেন চট্টগ্রামের জলিলগঞ্জের টেকপাড়ার ছোট্ট একটি বাসায়। সংসার শুরু করেছেন এক বছরও পূর্ণ হয়নি। কয়েক দিন পরে এথেলবার্ট বাবা হবেন। এ জন্য সন্তানসম্ভবা স্ত্রী লুসিয়ানাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বরিশালের গ্রামের বাড়িতে। বউকে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে এথেলবার্ট দিন গুনতেন কবে শুনবেন সুখবর। কবে দেখবেন সন্তানের মুখ; কিন্তু ভাগ্য তাঁকে নিয়ে গেছে পরপারে। সন্তানের জন্মের পরের দিন তিনি লালদীঘিতে জনসভায় পুলিশের গুলিতে মারা যান। তার শিশুটি কী হতভাগ্য! নিজের বাবাকে কোনো দিন দেখতে পেল না। এ রকম কমপক্ষে ২৪টি করুণ কাহিনির জন্ম দিয়েছে চট্টগ্রাম গণহত্যা।  ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি সংঘটিত হয় একটি গণহত্যা। মূলত এটি ছিল গণতন্ত্রসহ মানুষের নানা অধিকার কেড়ে নিতে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। কবি শামসুর রাহমান এ ঘটনাকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘ চট্টগ্রাম গণহত্যা জালিয়ানওয়ালাবাদ হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য বলে আমি মনে করি। গণতন্ত্রের দাবীতে দেশের জনগণ যদি সোচ্চার হয়, সেই নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলী করা অন্যায় ও গর্হিত কাজ। আমার মনে হয় বর্তমানে সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি হোক।’ প্রফেসর আনিসুজ্জান ২৪ জানুয়ারির গণহত্যা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘ আমি চট্টগ্রাম গণহত্যার খবরটি শুনে তাৎক্ষণিকভাবে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম...... সেই মৃত্যু বৃথা যায়নি। স্বৈরশাসক এরশাদের আজ পতন হয়েছে।’

 বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘১৯৮২ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত যে গণ-আন্দোলন চলছিল, চট্টগ্রাম গণহত্যা ছিল সেই আন্দোলনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ‘উৎকট ও উগ্রপ্রকাশ হত্যাকাণ্ড'। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। । পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। এরশাদ সরকার নিজ দেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে যা ইতিহাসের সকাল বর্বরতাকে হার মানিয়ে দেয়।’

পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ছুড়তে থাকে। ট্রাকের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকে লুটিয়ে পড়েন। আহত ব্যক্তিদের আর্তচিৎকার, কাঁদানে গ্যাস, গুলির আওয়াজ, ছোটাছুটি, স্লোগান—সব মিলিয়ে এক নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় আদালত ভবন থেকে আইনজীবীরা মিছিল করে এসে নেতাদের ট্রাকটিকে আদালত ভবনের পাহাড়ে নিয়ে যান।

চট্টগ্রাম গণহত্যা পারম্পর্যহীন, বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। কিংবা এমন নয় সেদিন বিশাল জনসমুদ্রের অভিঘাতে বেসামাল হয়ে পুলিশ ও বিডিআর দিনভর গুলির মহড়া চালিয়েছিল জনতার ওপর। আমাদের জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসের সঙ্গে এ ঘটনার ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। এই দেশ ও দেশের মানুষের বিরুদ্ধে নানা সময় ও নানা যুগে নানা চক্রান্ত হয়েছে। সেই চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন ১৫ দলীয় জনসভায় নির্বিচার গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম গণহত্যার প্রকৃত তথ্য জেনেও সরকারি চাপ ও হুমকির মুখে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলো। প্রকৃতপক্ষে কতজন শহীদ হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছেন, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ কোথাও প্রকাশিত হয়নি। পরে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সংকলনে বিভিন্ন তথ্য ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

কী ঘটেছিল সেদিন?

স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৮৮ সালের ২৩ জানুয়ারি ১৫, ৭ ও ৫ দলের লিয়াজোঁ কমিটির এক সভায় ২৪ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই প্রতিরোধ সপ্তাহের প্রথম দিন ১৫ দলের পক্ষে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জনসভা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। জনসভার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণাও চালানো হয়। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনতা এই জনসভার জন্য বিপুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সভার দিন ভোর থেকে শত শত পুলিশ লালদীঘি ময়দান ঘিরে রাখে। জনসভাকে নিয়ে মানুষের মধ্যে এক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পুলিশ সকাল থেকে মাঠে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি; কিন্তু বেলা যতই বাড়তে থাকল, ততই আশপাশের এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মী ও সাধারণ মানুষের আগমন বাড়তে থাকল। এই গণসমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল  ১৫ দলের নেতাদের। তাঁরা সকাল সাড়ে আটটায় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছান। ১৫ দলের নেতারা চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে লালদীঘির মাঠে আসার পথে হাজার হাজার মানুষের সামনে ২৪টি পথসভা করেন। পথে পথে মানুষের ঢল। সেই জনস্রোত পেরিয়ে লালদীঘির কাছাকাছি আসতে নেতাদের সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা।  তাঁদের বহনকারী ট্রাক নিয়ে বিশাল শোভাযাত্রা বেলা পৌনে দুইটায় বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের পাশে আসে। কয়েক শ গজ দূরে লালদীঘি ময়দান। গাড়ি আদালত ভবনের গেটে এসে পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয় এবং হঠাৎ সমবেত জনতার ওপর চড়াও হয়। নেতারা পুলিশকে অনুরোধ করেন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে কোনো ধরনের হামলা না চালাতে; কিন্তু সেদিকে কর্ণপাত না করে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ছুড়তে থাকে।  ট্রাকের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকে লুটিয়ে পড়েন। আহত ব্যক্তিদের আর্তচিৎকার, কাঁদানে গ্যাস, গুলির আওয়াজ, ছোটাছুটি, স্লোগান—সব মিলিয়ে এক নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় আদালত ভবন থেকে আইনজীবীরা মিছিল করে এসে নেতাদের ট্রাকটিকে আদালত ভবনের পাহাড়ে নিয়ে যান। এরপর পুলিশ সাংবাদিকদের গাড়ির ওপর হামলা করে। তাতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হন। পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে জনতার মিছিল। যে যেদিকে পারে প্রাণ বাঁচাতে ছুটছিল। ছুটতে ছুটতে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। কেউ মাটিতে, কেউ ড্রেনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।

আন্দরকিল্লায় জনতার দিকে বন্দুক তাক করেছে পুলিশ
ছবি: সংগৃহীত

লালদীঘি পাড়ের ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। শহরজুড়ে পুলিশ ও বিডিআরের সঙ্গে শুরু হয় ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ। এ রকম সংঘর্ষ চলতে থাকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ বেপরোয়া গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে এলোপাতাড়ি লাঠিপেটা করে। এসব কারণে বহু লোক হতাহত হন। বেলা তিনটা থেকে চারটার মধ্যে রেয়াজুদ্দীন বাজার এলাকা, জিপিওর সম্মুখভাগ, স্টেশন রোড, রাইফেল ক্লাব, নিউমার্কেট চত্বর এলাকায় পুলিশ ও বিডিআরের গুলিতে সর্বাধিক সংখ্যক লোক মারা যান। সন্ধ্যার পর শহরের হাসপাতালে ও ক্লিনিকগুলোতে আহতদের ভিড়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ডাক্তার, নার্স ও ছাত্রছাত্রীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তাদের চিকিৎসা দিতে। হাসপাতালগুলোর আঙিনা রক্তে লাল হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে আহতদের বাঁচানোর জন্য প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ কথা জানার পর ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানে ইচ্ছুক মানুষের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়।

২৪ জানুয়ারি ঘটনার দিন এবং পরে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে মারা যাওয়া ২৪ জনের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন মহিউদ্দীন শামীম, বদরুল, মোহাম্মদ হাসান, এথেলবার্ট গোমেজ, স্বপন বিশ্বাস, স্বপন চৌধুরী, রমেশ বৈদ্য, জি, কে, চৌধুরী; সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, কাশেম, সমর দত্ত, পলাশ, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, শাহাদত হোসেন, হাসান, চান মিঞা, ডি কে দাশ, কুদ্দুস, পংকজ বৈদ্য, গোবিন্দ দাশ, বাহার উদ্দিন ও অজিত সরকার।

২৪ জনের নাম পাওয়া গেলেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা, নিহত মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে অর্ধশতাধিক হবে। সেদিন সন্ধ্যার পর শহরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিহত ও আহত মানুষে ভরে যায়। এ সময় পুলিশ লাশ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ করায় তিনটির বেশি ছিনিয়ে নিতে পারেনি। ধর্মের বাছবিচার না করে বেশ কয়েকটি লাশ শ্মশানে পোড়ানো হয়েছে বলে সেখানকার ডোম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। লাশ গুম করে, নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে সরকার চেয়েছিল আসল সত্য ঢাকা রাখতে। লাশ গুম করার এই ঘটনা মানুষের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। এই ঘটনা নিয়ে রচিত কবি ত্রিদিব দস্তিদারের একটি কবিতা ব্যাপক পঠিত ও জনপ্রিয় হয়।

গুম লাশ. লাশ গুম

লালদীঘি নড়ে ওঠে

কাঠগড়ায়

রক্ত–পলাশ লেখে

প্রেস নোট

মৃতের সংখ্যা নিয়ে হৈচৈ্

গুম লাশ, লাশ গুম

অগ্নিসাক্ষী রাখে

কালু ডোম

বিচার দণ্ড হাতে সূর্য সেন

কাজেমালী দেখে তার মাপ

গুম লাশ। লাশ গুম।

(গুম লাশ: ত্রিদিব দস্তিদার)

পত্রপত্রিকাকে সরাসরি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল নিহত মানুষের সংখ্যা প্রকাশ না করতে। পত্রিকায় প্রকাশিত না হলেও মানুষ কিন্তু জেনে যায় এই বর্বর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, ‘এরশাদ আমলে স্বৈরশাসনের দুটি চরিত্র ছিল একটি প্রকাশ্য, অন্যটি অপ্রকাশ্য। আমার মনে হয় প্রকাশ্যে নির্যাতনের মধ্যে চট্টগ্রাম গণহত্যা ছিল নিকৃষ্টতম।’

 ২৪ জানুয়ারির এই হত্যাকাণ্ড এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে। এ ঘটনার দুই বছর পর এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।