যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের পরীক্ষা করতেন, এবার নিজের মেয়ের সেই পরীক্ষা করতে হলো মাকে

শিশু ধর্ষণপ্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

মেয়ের বয়স এখনো ছয় বছরে পা দেয়নি। তার প্যান্টে রক্ত দেখে বুক কেঁপে উঠেছিল মায়ের। তিনি মনে মনে চাচ্ছিলেন, যা ভাবছেন—তা যেন সত্যি না হয়।

এই মা নিজে একজন চিকিৎসক, সার্জন। বর্তমানে বগুড়ায় কর্মরত। আগে রাজধানীর একটি হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে কাজ করার সময় ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) অধীনে ভর্তি শিশুদের পরীক্ষা করেছেন, ক্ষতবিক্ষত যোনিপথ অস্ত্রোপচার করে ঠিক করেছেন। এবার তাঁকে নিজের মেয়ের একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হলো। এরপর থানায় বসে তাঁর মেয়ে নারী পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বলে, ‘দাদু আমাকে ব্যথা দিয়েছে।’

বগুড়া থেকে এই মা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলছিলেন নিজের এই অভিজ্ঞতার কথা; শুনিয়েছেন তার একাকী লড়াইয়ের গল্প।

আশঙ্কা সত্যি হলো

শিশুটির দাদার বয়স প্রায় ৮০ বছর। মেয়ের বক্তব্য শোনার পর এই মা প্রথমে কিছুটা নিশ্চিত হন, মেয়ের প্যান্টে রক্ত দেখে তিনি যে আশঙ্কা করেছিলেন, তা হয়তো সত্যি।

এ ঘটনার পর মেয়ের যোনিপথ খালি চোখে পরীক্ষা করে যা দেখেছেন, তা তিনি মামলার এজাহারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।

তবে একদিকে নিজের মেয়ে, অন্যদিকে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শ্বশুর। এ কারণে স্বামীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা কেউই মামলা করতে চাননি। কিন্তু মা তা মানতে পারেননি। তাই তিনি একাই থানায় গিয়ে মামলা করেন।

আমি যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন মেয়ের ন্যায়বিচারের জন্য লড়ে যাব।
শিশুটির মা

একার লড়াই

মেয়েকে সরকারি হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে চিকিৎসা করিয়েছেন। এখনো একাই সব পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন এই মা।

মেয়েটি অনেক ছোট হওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়ার সময় পুলিশ মাকে কাছে থাকতে দেয়নি। ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি। আর বয়সসহ অন্যান্য বিবেচনায় আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন অভিযুক্ত শ্বশুর।

মামলা সঠিক ধারায় হয়েছে কি না—এসব নিয়ে এই মা এখন চরম সংশয়ে ভুগছেন। এ ছাড়া পরিবার-পরিজনের বিরোধিতার পরও মেয়ের জন্য তাঁকেই ন্যায়বিচারের লড়াই একা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

‘আমি যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন মেয়ের ন্যায়বিচারের জন্য লড়ে যাব’—এভাবেই বলেছেন ওই মা।

ঘটনার দিন

এই মা বলেন, তাঁর স্বামীও একজন চিকিৎসক। গত ২৮ নভেম্বর ব্যক্তিগত কাজে তিনি ঢাকায় ছিলেন। সেদিন মেয়ে তার বাবার সঙ্গে বগুড়া শহরের বাসা থেকে পাশের উপজেলায় দাদার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। রাতে বগুড়ায় ফিরে তিনি বাসার গৃহকর্মীর কাছ থেকে মেয়ের রক্তাক্ত প্যান্ট দেখতে পান।

পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে মেয়ের যোনিপথ পরীক্ষা করে তাঁর মনে হয়েছে, বয়স অনুযায়ী জায়গাটি অস্বাভাবিকভাবে প্রশস্ত। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে যাওয়ার লক্ষণ, লালচে ভাব—সবই আঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

একদিকে নিজের মেয়ে, অন্যদিকে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শ্বশুর। এ কারণে স্বামীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা কেউই মামলা করতে চাননি। কিন্তু মা তা মানতে পারেননি। তাই তিনি একাই থানায় গিয়ে মামলা করেছেন।

দ্বিতীয় চিকিৎসকের মতামত

এই মা যে হাসপাতালে বর্তমানে কর্মরত, সেখানকার আরেকজন সংশ্লিষ্ট নারী চিকিৎসককে বিষয়টি জানান তিনি। ওই চিকিৎসক বাসায় এসে মেয়েটিকে খালি চোখে পরীক্ষা করেন এবং প্রায় একই পর্যবেক্ষণের কথা বলেন। মেয়ের বাবার উপস্থিতিতেই এই পরীক্ষা করা হয়।

এর পরদিন মেয়েকে একটি হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। সেখানে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসা চলে। দায়িত্বরত চিকিৎসকদের মৌখিক বক্তব্যও শিশুটির মায়ের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলে যায়।

মামলা ও সন্দেহ

শ্বশুরের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে এই মা বলেন, ঘটনার পরপরই তিনি মামলা করেননি। মেয়ের বাবার কাছে বারবার জানতে চেয়েছেন কীভাবে এমন ঘটনা ঘটতে পারে? কিন্তু তাকে একবার বলা হয়, বালুতে খেলতে গিয়ে জোঁক ঢুকেছে। আবার বলা হয়, লাঠি দিয়ে খেলতে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। এমনকি মাসিক হওয়ার কথাও বলা হয়।

এই মা বলেন, ‘মেয়ের এ অবস্থার জন্য তার বাবার কোনো উদ্বেগ কাজ করেনি। এ কারণে আমি একা প্রথমে অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে মামলা করতে থানায় যাই। সে সময় মেয়ে নারী পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বলেছে, ওর দাদু তাকে ব্যথা দিয়েছে। এরপর ৩ ডিসেম্বর শ্বশুরকে আসামি করে মামলা করি।’

শিশুটির বাবার সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মুঠোফোনে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তাঁকে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তার কোনো জবাব আসেনি।

মেয়ের এ অবস্থার জন্য তার বাবার কোনো উদ্বেগ কাজ করেনি। এ কারণে আমি একা প্রথমে অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে মামলা করতে থানায় যাই। সে সময় মেয়ে নারী পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বলেছে, ওর দাদু তাকে ব্যথা দিয়েছে। এরপর ৩ ডিসেম্বর শ্বশুরকে আসামি করে মামলা করেছি।
শিশুটির মা

যে ধারায় মামলা হয়েছে

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থানায় ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ নম্বর ধারা এবং ১৮৬০ দণ্ডবিধির ৩২৪ ধারায় মামলাটি করা হয়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে তাঁর যৌন কামনা চরিতার্থ করার জন্য তাঁর শরীরের যেকোনো অঙ্গ বা কোনো বস্তু দিয়ে কোনো নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করেন, তাহলে তাঁর এই কাজ হবে যৌনপীড়ন। এ অপরাধের শাস্তি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।

অন্যদিকে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩২৪ ধারা বলছে, বিপজ্জনক অস্ত্র বা উপায় (যেমন ধারালো অস্ত্র) ব্যবহার করে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে আঘাত করলে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান আছে।

শিশুটির মা বলেন, ‘আমি মামলার এজাহারে সবকিছু স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছি। আমি একজন সার্জন। মেয়ের শারীরিক অবস্থা বুঝতে পারলেও মামলার ধারা তো বুঝি না।’

নাতনিকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় দাদাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরে তিনি জামিন পেয়েছেন।

শিশুটির মা প্রথম আলোকে বলেন, এজাহারে ঘটনার বিস্তারিত উপাদান যথেষ্ট স্পষ্ট নয়—এই যুক্তিতে এবং আসামির বয়স বিবেচনায় জামিন আদালত আসামির জামিন মঞ্জুর করেন।

আরও পড়ুন

হারিয়ে যাওয়া প্রমাণ

ঘটনার দিন মেয়ের রক্তমাখা প্যান্ট প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন মা। সকালে উঠে দেখেন, সেটি নেই। বাসার সিসি ক্যামেরাও কাজ করছিল না।

মা বলেন, ‘বাসায় আমার স্বামী, একজন অবিবাহিত ননদ ও চারজন কাজের মানুষ ছাড়া কেউ নেই। তাহলে প্যান্টটা কে নিল? বাসার সিসিটিভি কেন কাজ করছে না, তার উত্তরও স্বামীর কাছ থেকে পাইনি। সব মিলে আমার সন্দেহটা বাড়ছেই।’

স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন কারণে আগে থেকেই মনোমালিন্য চলছে বলে জানান এই মা। তিনি বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, সংসার করতে চাচ্ছি না বলেই মিথ্যা অভিযোগ করেছি।’

এই মা বলেন, ‘আমি যদি সংসার না চাইতাম, তালাক দিতে পারতাম। স্বামীর বিরুদ্ধেই মিথ্যা অভিযোগ করতে পারতাম। আমি কেন আমার শ্বশুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করব?’

শিশুটির বর্তমান অবস্থা ও তদন্ত

ঘটনার পর শিশুটি মানসিক ট্রমায় ছিল উল্লেখ করে তার মা বলেন, ‘মেয়ে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে এসব নিয়ে বারবার প্রশ্ন করা হলে সে বিরক্ত হচ্ছে।

মামলাটির তদন্ত করছেন দুপচাঁচিয়া থানার তদন্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান সরকার। তিনি মুঠোফোন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত চলছে। এর বাইরে কিছু বলা সম্ভব নয়।’