অসংখ্য দেশপ্রেমিকের ছোট্ট একটা ভালো কাজে রমজান হোক সবার

ভালো কাজের ধারাবাহিকতায় রমজান মাসের পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়ুক বছরব্যাপী
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের শৈশবের রমজান মাস আজকের মতো বর্ণিল ইফতারের বিকিকিনি আর সাহ্‌রি–পার্টির চোখধাঁধানো আলোয় পরিপূর্ণ ছিল না। কিন্তু তবুও আমাদের মনের গহিনে রমজান মাসের যে অপরূপ শোভা গাঁথা আছে, সে আলোয় ম্লান হয়ে যায় আজকের ইফতার কিংবা সাহ্‌রির জাঁকজমক।

প্রায়ই ভাবি, কী ছিল আমাদের শৈশবের রমজান মাসে, যা এখন আর নেই? এই প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া এত সহজ নয়। কারণ শৈশব–রাঙানো রমজানের এই মুগ্ধতার পেছনে আছে আমাদের আবেগ, অনুভূতি আর কিছু আদর্শের চর্চা। সেসব আজ আমরা অনেকটাই হারাতে বসেছি।  

আমাদের স্কুলজীবনে রমজান মাসের আনন্দ শুরু হয়ে যেত রোজা শুরু হওয়ার আগে থেকেই। রমজান মাসের পুরোটা সময় আমাদের স্কুল বন্ধ থাকত। যেদিন স্কুল বন্ধ হতো, সেদিন কোনো ক্লাস হতো না। স্কুলের সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর কর্মচারী মিলেমিশে আমরা আনন্দ ভাগ করে নিতাম। সেই আয়োজনে যোগ দিত অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও। কী দারুণ সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের চর্চা ছিল আমাদের সময়ে! আমরা একসঙ্গে মজা করতাম, খাওয়াদাওয়া করতাম, প্রিয় শিক্ষকদের ফুল উপহার দিতাম। আজকাল এ রকমটা হয় কোথায়? ঈদ, পূজা–পার্বণের উদ্‌যাপন শুধু নির্দিষ্ট ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ধর্ম যার যার উৎসব যেন সবার—এটাই ছিল আমাদের উৎসব আয়োজনের মূলমন্ত্র। বাড়ির দুয়ারে নিয়মিত কিছু ভিখারির দেখা মিলত এই মাসে। তারাও যেন আমাদের পরিচিত আপনজন। অনেক সময় সেই সম্পর্কের সূত্রেই দাবি করে ভরতেন ভিক্ষার ঝুলি। সেটি কিন্তু মোটেই চাঁদাবাজি ছিল না। ছিল মানবতার কাছে প্রত্যাশা।  

আমাদের এখনকার রমজান মাস শুরু হয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অভিশাপ নিয়ে। রমজান মাস শুরু হতে না হতেই কাঁচা মরিচ, শসা, বেগুন, ধনেপাতা, লেবু যেন ‘তারকা শাকসবজি’তে পরিণত হয়। সয়াবিন তেল উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা তো আজকাল নিয়মিত। ঈদের বাজারের আঁচ টের পাওয়া যায় প্রথম রমজান থেকেই, যা ক্রমবর্ধমান থাকে চাঁদরাত পর্যন্ত। রাস্তার জ্যাম বাড়ে আর সেই সঙ্গে রাস্তার ট্রাফিক পুলিশদের হঠাৎ তৎপরতা। পকেটমার কিংবা হাইজ্যাকারদের উৎপাত বাড়ে। অন্যদিকে কোনোরকমে পনেরো রোজা পার হতে না হতেই শুরু হয় ঈদের চাঁদা কিংবা সালামি সংগ্রহের ব্যাকুলতা। দিনভর ট্রাফিক জ্যামে আবদ্ধ নগরজীবনে রমজানের সৌন্দর্য কোথায়! ঈদের শপিংয়ের মতো চরম আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তরা বিবর্ণ হয়ে যায় দমদন্ধ করা ট্রাফিক জ্যামে। সংযমের মাসকেই আমরা অসংযম আর দুর্নীতি চর্চার মাসে পরিণত করে ফেলি কী অনায়াসে।

রমজান মাস পবিত্র ও সুন্দর। কিছু লোভী মানুষের অসৎ উদ্দেশ্যের কাছে পরাজিত হতে পারে না এই মাসের সৌন্দর্য আর ঐতিহ্য। রমজান মাসের পবিত্রতা আর সৌন্দর্য রক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণই আমাদের ওপর। কারণ এই রমজান মাসেই আছে অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো অনেক আয়োজন। এই মাসেই আমরা প্রত্যক্ষ করি পথশিশুদের ইফতার করানো কিংবা নতুন জামা কিনে দেওয়ার মতো অনেক স্বর্গীয় উদ্যোগ। জাকাতের অর্থ বিতরণ কিংবা জাকাতের অর্থে দরিদ্রদের মাঝে শাড়ি, লুঙ্গি, জামা দেওয়ার মতো চমৎকার ছবিগুলো রচিত হয় এই রমজানেই। আমাদের এই উদ্যোগগুলো আমরা কি আরেকটু সম্প্রসারিত ও সমন্বিত করতে পারি না? আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকে যদি পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে করা যেত, তাহলে আমাদের পক্ষে হয়তো আরও অনেক অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব হতো। আমাদের আরেকটু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ অনেক মানুষের ঈদের খুশি অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমন গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কারখানার শ্রমিকদের যথাসময়ে বেতন ও বোনাস প্ররিশোধ করা, বাস কর্তৃপক্ষ থেকে রাস্তার ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা যাত্রীদের জন্য সামান্য ইফতারির আয়োজন করা, ট্রাফিক পুলিশদের শরবত বা ইফতারি দেওয়া ইত্যাদি।

আমি বিশ্বাস করি, এখনো এই দেশে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন দেশের মানুষকে। অনেকেই আছেন, যাঁরা সব সংকীর্ণতা কিংবা সাম্প্রদায়িক চিন্তার ঊর্ধ্বে থেকে মানবতার জন্য নীরবে–নিভৃতে কাজ করেন। আসুন, এই রমজানে আমাদের মধ্যে বাস করা সেই শুভশক্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলি। শুভশক্তির কাছে পরাজিত হোক সকল অকল্যাণ, অসুন্দর আর অসংগতি। আমাদের ইতিবাচক ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়িত হোক, শুভশক্তিরা ছড়িয়ে পড়ুক।

দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। দেশপ্রেমের সংজ্ঞা ব্যাপক। এর ব্যাপ্তিও ঘটে নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে। যার যার জায়গা থেকে, সৎ থেকে ভালো কাজ করাটাই, মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাও দেশপ্রেমেরই অংশ। আমাদের আশপাশেই ছড়িয়ে আছেন এমন অসংখ্য দেশপ্রেমিক। যাঁদের ছোট্ট ছোট্ট ভালো কাজ আর উদ্যোগ এখনো টিকিয়ে রেখেছে আমাদের মানবতার পরিচয়টুকু।

তাঁদের মতো মানুষের হাত ধরেই ভালো কাজের ধারাবাহিকতায় রমজান মাসের পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়ুক বছরব্যাপী। সারা বছর ধরে আমাদের ভালো কাজের আলো ছড়াক। মানবতার জয় হোক। মানবতা মহিমান্বিত হোক।

  • নিশাত সুলতানা: লেখক ও উন্নয়নকর্মী