পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতার জেরে ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার’ ব্যানারে ডাকা ৭২ ঘণ্টার অবরোধের শেষ দিন গতকাল সোমবারও খাগড়াছড়িতে যানবাহন চলাচল করেনি। তবে রাঙামাটিতে কিছু যানবাহন চলেছে। খুলেছে দোকানপাটও। বাজারেও লোকসমাগম হচ্ছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
সহিংসতার ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা করেছে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন। তালিকা অনুযায়ী সহিংসতায় যানবাহন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ড–ভাঙচুরে ক্ষতির পরিমাণ ৯ কোটি ২২ লাখ টাকা।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সহিংসতায় ৪৬টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৮৯টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। অন্যদিকে ২টি সরকারি প্রতিষ্ঠান, ৮টি ব্যাংক, ১৮টি বসতঘর, ৮৫টি অস্থায়ী ভাসমান দোকান, ২টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুর করা হয়।
এদিকে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিয়েছেন রাঙামাটি শহরের কাঁঠালতলী এলাকায় মৈত্রী বিহারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। গত শুক্রবারের হামলায় বিহারটির দানবাক্স লুট, বুদ্ধমূর্তিসহ মন্দিরে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়। সংবাদ সম্মেলন থেকে এসব ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান ভিক্ষুরা।
গতকাল হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। ক্ষয়ক্ষতি যাঁদের হয়েছে, তাঁদের কিছু সাহায্য করার চেষ্টা থাকবে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি।’
৭২ ঘণ্টা অবরোধের পাশাপাশি রাঙামাটিতে গাড়ি ভাঙচুরের প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডেকেছিলেন পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা। রোববার রাতেই ধর্মঘটন প্রত্যাহার করা হয়। এরপর গতকাল সকাল থেকে শহরে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে।
রাঙামাটি সিএনজি অটোরিকশাচালক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রোববার সন্ধ্যার দিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর গতকাল সকাল থেকে শহরের অটোরিকশা চলাচল করছে। বাস-ট্রাক চলাচলও স্বাভাবিক হয়েছে।
শহরে দোকানপাটও খুলেছে। তিন দিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাঙামাটি শহরের বনরূপা ও নিউমার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ি ও বাঙালিরা বাজারে আসছেন। বনরূপা বাজারে বেচাকেনা হচ্ছে।
খাগড়াছড়িতে এখনো আতঙ্ক
এদিকে ৭২ ঘণ্টার অবরোধের শেষ দিন গতকালও খাগড়াছড়ি থেকে দূরপাল্লার কোনো যানবাহন ছেড়ে যায়নি। বাস চলেনি অভ্যন্তরীণ সড়কেও। এতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে যেতে ইচ্ছুক লোকজন ভোগান্তিতে পড়েছেন।
বাস চলাচল না করলেও শহরের শাপলা চত্বর, আদালত সড়ক, বাস টার্মিনাল, চেঙ্গি স্কয়ার, মধুপুর সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল স্বাভাবিক ছিল। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছিল না শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাহী সদস্য মো. আবদুল মোমিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহনশ্রমিক ও সাধারণ যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার (আজ) থেকে সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
গত বুধবার খাগড়াছড়ি সদরে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামের এক বাঙালি যুবকের মৃত্যুর পর সংঘর্ষ শুরু হয়। ওই দিন সেখানকার পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
হত্যার এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বাঙালিদের অভিযোগ, মিছিলটি বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় পাহাড়িরা বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সংঘর্ষের এক পর্যায়ে দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে বিভিন্ন দোকান ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়।
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান পুড়ে গেছে। এর মধ্যে পাহাড়িদের ৭৮টি ও বাঙালিদের ২৪টি দোকান রয়েছে।
দীঘিনালা উপজেলায় সংঘর্ষের জেরে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, পানছড়ি ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় তিনজন নিহত হন।
খাগড়াছড়িতে তিন পাহাড়ির মৃত্যু ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার সকালে রাঙামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন পাহাড়িরা। মিছিলে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে অনিক কুমার চাকমা (২৫) নামের এক তরুণ মারা যান। এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতার ব্যানারে অবরোধের ডাক দেওয়া হয়েছিল।