চার বিদেশি কোম্পানির তিনটিই চলে গেছে, ১০ বছরেও নতুন দরপত্র হয়নি

বঙ্গোপসাগরে সব মিলিয়ে অনুসন্ধান এলাকা (ব্লক) আছে ২৬টি
ফাইল ছবি

সমুদ্র বিজয়ের এক দশক পরও গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন অগ্রগতি নেই। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে চারটি বিদেশি কোম্পানি কাজ শুরু করলেও তিনটি চলে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য গত ১০ বছরে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। নতুন দরপত্র আহ্বানের উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) চূড়ান্ত হয়নি দুই বছরে। চলতি বছরও নতুন চুক্তির সম্ভাবনা কম।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তিনজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সর্বশেষ দরপত্র ডাকা হয়েছিল ২০১২ সালে। ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি। দুই বছরের বেশি সময় ধরে নতুন পিএসসির কাজ চলছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র বলছে, পিএসসি-২০২২ নামের নতুন খসড়া ইতিমধ্যে আইন মন্ত্রণালয় থেকে আইনি যাচাই (ভেটিং) শেষে জ্বালানি বিভাগে এসেছে। এখন এই খসড়া অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে। কারণ, জ্বালানি মন্ত্রণালয় তাঁর অধীনে। তাঁর অনুমোদনের পর খসড়া যাবে মন্ত্রিসভায়।

পেট্রোবাংলার দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক মাসের মধ্যেই হয়তো নতুন পিএসসি দরপত্র আহ্বান করা যাবে। দরপত্রে অংশ নিতে তিন মাস সময় দেওয়া হবে। আগ্রহী কোম্পানিও হয়তো কিছু পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে এই প্রক্রিয়ায় আরও কয়েক মাস লাগবে। কিন্তু বছর শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন সামনে রেখে এই চুক্তি স্বাক্ষর আটকে যেতে পারে। তা ছাড়া দরপত্র আহ্বানের পর চুক্তি স্বাক্ষর করতে সাধারণত এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়। আর চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এনে কাজ শুরু করতে লাগে আরও অন্তত এক বছর।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পিএসসি সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। পরের বছরের শেষ দিকে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় গত বছরের আগস্টের দিকে। বছর শেষে তা পাঠানো হয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ বিষয়ে বলেন, গ্যাসের দাম ও উৎপাদন ভাগাভাগির বিষয়টি আকর্ষণীয় হলে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি দরপত্রে অংশ নিতে আগ্রহী হবে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে পিএসসির নতুন খসড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এখন তা অনুমোদনের অপেক্ষায়।

বদলাচ্ছে গ্যাসের দাম ও মুনাফা ভাগাভাগি

পিএসসি-২০১৯ অনুসারে, প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম রাখা হয়েছিল গভীর সমুদ্রের জন্য সোয়া সাত মার্কিন ডলার। আর অগভীর সমুদ্রের জন্য দাম ধরা হয়েছিল সাড়ে পাঁচ ডলার।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানায়, নতুন পিএসসির খসড়ায় কোনো নির্ধারিত দাম রাখা হয়নি। এতে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) দামের ১০ শতাংশ গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে-বাড়লে আনুপাতিক হারে গ্যাসের দামও কমবে-বাড়বে।

এখন বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৭০ ডলার। খসড়ার হিসাব অনুযায়ী, সে ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরে গ্যাসের দাম হবে ৭ ডলার। আবার জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ১০ ডলার।

আরও পড়ুন

বহুজাতিক কোম্পানি ও পেট্রোবাংলার মধ্যকার মুনাফা ভাগাভাগির সূত্র এবার বদল করা হচ্ছে। আগে বিনিয়োগ ও পরিচালন খরচ তুলে নেওয়ার পর মুনাফা ভাগাভাগি করত দুই পক্ষ। এতে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ৫৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পেত পেট্রোবাংলা। উৎপাদন বাড়লে পেট্রোবাংলার মুনাফার হার বাড়ত। তবে এবার গ্যাসক্ষেত্র থেকে আয় করা মোট রাজস্বের ওপর ভাগাভাগির ব্যবস্থা হচ্ছে। এতে ৩৫ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্বের ভাগ পাবে পেট্রোবাংলা। শুরুতে ঠিকাদার কোম্পানির বিনিয়োগের খরচ তোলার সময় পেট্রোবাংলার আয় কম হবে। ধীরে ধীরে খরচ কমে আসবে। তখন পেট্রোবাংলার আয় বাড়বে।

পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পরামর্শক কোম্পানির সুপারিশে এই পদ্ধতি রাখা হচ্ছে। এতে বিদেশিদের আগ্রহ বাড়বে। তেল-গ্যাস খাতের অন্যতম শীর্ষ বহুজাতিক কোম্পানি এক্সনমবিল ইতিমধ্যে দরপত্র ছাড়া চুক্তি করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমন কোম্পানির আগ্রহ সমুদ্রে গ্যাস থাকার সম্ভাবনার বিষয়টিকে আরও জোরালো করে।

ওএনজিসি সময় পেছাচ্ছে বারবার

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অগভীর সমুদ্রের ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে পিএসসি সই করে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড (ওভিএল)। চুক্তি অনুয়ায়ী, চার বছরের মধ্যে জরিপ ও দুটি কূপ খননের কথা ছিল। কিন্তু ওভিএল নির্ধারিত সময়ে তা করতে না পারায় তিন বছর সময় বাড়ানো হয়। একটি কূপ খনন করে গ্যাসের সন্ধান পায়নি ওভিএল। বাকি দুটি কূপ খনন করতে আরও দুই বছর সময় বাড়ানো হয়েছে। এখন তারা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় পাবে। দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে একমাত্র বিদেশি কোম্পানি হিসেবে তারাই এখন কাজ করছে। তবে ওভিএলের কাজের গতিতে সন্তুষ্ট নয় পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ওভিএলকে বারবার তাগাদা দিয়ে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। কূপ খননের জন্য এখন পর্যন্ত তারা ঠিকাদার নিয়োগ করেনি।

শেষ হয়নি বহুমাত্রিক জরিপ

আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি হয়। অবশ্য তার আগেই বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে বাংলাদেশ। কাজ শুরু করলেও বিভিন্ন অজুহাতে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায় মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস, অস্ট্রেলিয়ার স্যান্তোস ও সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি গঠিত যৌথ কোম্পানি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু।

২০১৩ সালেই সমুদ্রে জরিপ চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে মিয়ানমার। অন্যদিকে দেশে বহুমাত্রিক জরিপ চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৪ সালে। ২০১৫ সালে জরিপের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। জ্বালানি বিভাগের পরামর্শে ২০১৬ সালে পুনঃ দরপত্রে একই কোম্পানি নির্বাচিত হয়। ২০২০ সালের মার্চে চুক্তি হয়। আর কাজ শুরু হয়েছে মাত্র দুই মাস আগে। চুক্তি অনুযায়ী, নিজস্ব অর্থায়নে জরিপের কাজটি যৌথভাবে করছে নরওয়ের টিজিএস ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফরাসি কোম্পানি স্লাম বে জ্যে। জরিপের তথ্য বিক্রি করে তারা বিনিয়োগের টাকা তুলবে।

পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ১১ হাজার লাইন কিলোমিটার জরিপ করার কথা। ইতিমধ্যে ১০ হাজার লাইন কিলোমিটারের বেশি জরিপ হয়ে গেছে। আগামী জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে জরিপের তথ্য পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন

এলএনজি আমদানিতে ঝোঁক

বঙ্গোপসাগরে সব মিলিয়ে ব্লক (অনুসন্ধান এলাকা) আছে ২৬টি। ২৪টি ব্লক খালি পড়ে আছে। দেশে গ্যাসের মজুত কমে আসছে। নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে ২০৩০ সালে গ্যাস উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে আসবে। ঘাটতি মেটাতে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। সামনে এলএনজি আমনদানি আরও বাড়ানোর নানা পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। চড়া দামে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে দফায় দফায়। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে দাম বাড়ানো হয় গড়ে ৮২ শতাংশ।

ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের দামে আপত্তি জানিয়ে আগে একাধিক বিদেশি কোম্পানি চলে গেছে। তাই কিছু সুবিধা দিয়ে হলেও বিদেশি কোম্পানির আগ্রহ বাড়ানো দরকার। কিন্তু পিএসসির খসড়া করতে এত সময় লাগার কথা নয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে এত ধীরগতি কোনো আন্তর্জাতিক কোম্পানি পছন্দ করে না। নিজস্ব গ্যাস বাড়াতে না পারলে চড়া দামে আমদানির দিকেই ঝুঁকতে হবে।

আরও পড়ুন