ট্রাইব্যুনালে সাজা হলে প্রার্থিতা নয়, দলের পদও থাকবে না

  • ২০১৮ সালের ‘জালিয়াতির’ নির্বাচনের দায় নিরূপণে বিশেষ তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ।

  • কোনো আসনে ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচনের প্রস্তাব।

  • এবার জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ।

ফেরারি আসামিদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখার সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নির্বাচন করতে পারবেন না এবং কোনো দলের সদস্য হতে পারবেন না।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গতকাল বুধবার সকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের সুপারিশের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তাঁদের সুপারিশগুলো ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সব মিলিয়ে ১৬টি ক্ষেত্রে ১৫০টির মতো সুপারিশ তুলে ধরেছে।

বিদ্যমান সংবিধান ও আইন অনুযায়ী, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যায় না। অনেকে উচ্চ আদালতে আপিল করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকেন।

কমিশনের সুপারিশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুরুতর দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের দায়ে আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনের অযোগ্য করার কথা বলা হয়েছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন খাতে সংস্কারের সুপারিশ পেতে সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছিল, যার একটি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। গত ৩ অক্টোবর সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে আট সদস্যের এই কমিশন গঠন করা হয়। অন্য সদস্যরা হলেন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, জেসমিন টুলী, মো. আবদুল আলীম, জাহেদ উর রহমান, মীর নাদিয়া নিভিন, মোহাম্মদ সাদেক ফেরদৌস ও সাদিক আরমান।

কমিশন সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অংশীজনদের সংলাপ করেছে। ডিজিটাল মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত মতামত নেওয়া হয়েছে। একটি জরিপও পরিচালনা করা হয়েছে। অংশীজনদের মতামতের পাশাপাশি কমিশন নিজেরা নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব আইন, বিধিবিধান পর্যালোচনা করে এই সুপারিশমালা তৈরি করেছে।

জাতীয় সংসদ ভবনে সংস্কার কমিশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়, সে লক্ষ্যেই কমিশন তাদের সুপারিশ তৈরি করেছে।

কমিশন ২০১৮ সালের ‘জালিয়াতির’ নির্বাচনের দায় নিরূপণ করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত কমিশন গঠন, কোনো আসনে ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন করা, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের দায়বদ্ধতা ও শাস্তির বিধান করার সুপারিশ করেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ হলো, এই নির্বাচন নির্দলীয় করা এবং এবার জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করারও সুপারিশ করেছে এই কমিশন। সব মিলিয়ে সংস্কার কমিশন ১৬টি ক্ষেত্রে ১৫০টির মতো সুপারিশ তুলে ধরেছে।

প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতা

সংস্কার কমিশন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্তদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার শুরু থেকেই সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য করার সুপারিশ করেছে। অর্থাৎ এই সুপারিশ কার্যকর হলে কোনো ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হলেই আর প্রার্থী হতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে আপিল করা না–করা কোনো ভূমিকা রাখবে না।

কমিশনের আরেকটি সুপারিশ হলো, গুরুতর মানবাধিকার (বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অমানবিক নির্যাতন, সাংবাদিকদের/মানবাধিকারকর্মী ওপর হামলা ইত্যাদি) এবং গুরুতর দুর্নীতি, অর্থ পাচারের অভিযোগে গুম কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশন বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত হলে তাঁদের সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। এ জন্য একটি বিশেষ আইন করার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিদ্যমান সংবিধান ও আইন অনুযায়ী, দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তি মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে কেউ প্রার্থী হতে পারেন না। এ ছাড়া ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীনে কোনো অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিও নির্বাচনের অযোগ্য। দুর্নীতির কারণে প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারিত ব্যক্তিও অযোগ্য।

অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনসংক্রান্ত বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ হলো, সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হতে হলে ওই দলে তিন বছরের সদস্যপদ থাকতে হবে। এখানে বলা হয়েছে, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিষয়ে একটি বিশেষ আইনের অধীনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগপত্র গৃহীত হলে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সাধারণ সদস্য বা কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।

তরুণ-সংখ্যালঘুদের জন্য ১০% মনোনয়ন

তরুণ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১০ শতাংশ মনোনয়নের সুযোগ তৈরির বিধান করা; স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধানের পরিবর্তে ৫০০ ভোটারের সম্মতির বিধান করা, এক ব্যক্তির একাধিক আসনে প্রার্থী হওয়ার বিধান বাতিল করা, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়া বা তথ্য গোপনের কারণে নির্বাচিত ব্যক্তিকে অযোগ্য ঘোষণা করার বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে।

ইসিকে শক্তিশালী করা

নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে। ওই আইন বা এর বিকল্প হিসেবে একটি স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ করা যেতে পারে বলে কমিশন মত দিয়েছে।

ক্ষমতা বাড়াতে ইসিকে নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষমতা দেওয়া, ইসি সচিব নিয়োগের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা, নির্বাচনের সময় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার মতো নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিশনের অনুমতি নেওয়ার বিধান করার সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে।

সংস্কার কমিশন মনে করে, ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪ সালের মতো বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ৯০ দিনের জন্য নির্বাচন স্থগিত করার ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া যেতে পারে। তবে নির্বাচন স্থগিত করা যাবে শুধু সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।

সংস্কার কমিশন বলেছে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে (গেজেট প্রকাশের আগে) ইসিকে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ঘোষণা দিতে হবে। এ বিষয়ে কোনো প্রার্থী বা দল সংক্ষুব্ধ হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাংবিধানিক কাউন্সিল বা আপিল বিভাগে অভিযোগ করতে পারবেন। সর্বোচ্চ ৭ দিনের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হবে।

ইসির দায়বদ্ধতা

ইসির ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের দায়বদ্ধ করার ব্যবস্থা করারও সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। নির্বাচন কমিশন কোনো অপরাধ বা অনিয়ম করলে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন আইনে বিধান রাখা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকালে কমিশনারদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অভিযোগ উঠলে তা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে সুরাহা করার বিদ্যমান বিধান কার্যকর করারও সুপারিশ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদের পরও যাতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটার কথাও বলেছে সংস্কার কমিশন।

রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন

নতুন দল নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ছাড়া দলের সাধারণ সদস্যদের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ; দলের সাধারণ সদস্যদের গোপন ভোটে দলের স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সব কমিটি নির্বাচিত করা; দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন, ভ্রাতৃপ্রতিম বা যেকোনো নামেই হোক না কেন, না থাকার বিধান করা; বিদেশি শাখা না রাখা; সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের জন্য দলের তিন বছরের সদস্য পদ থাকা বাধ্যতামূলক করা; প্রতি পাঁচ বছর পরপর দল নিবন্ধন নবায়ন বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া পরপর দুটি নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের নিবন্ধন বাতিলের বিধান বাতিল করতে বলেছে কমিশন।

না-ভোট রাখার সুপারিশ

সংস্কার কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক করা, প্রার্থীর বিদেশে সম্পদ থাকলে তার বিবরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, নির্বাচনী ব্যয় নজরদারি, নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারের বিধান বাতিল করা, নির্বাচনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বন্ধ করা, ‘না-ভোটে’র বিধান করা, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করা, ইসির কর্মকর্তাদের জন্য একটি পৃথক সার্ভিস সৃষ্টি করা, নির্বাচনসংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত কমিশনের যৌথ সিদ্ধান্তে করার বিধান করা, ইসির প্রশিক্ষণ ভাতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেটদের ভাতার যথার্থতা ও পরিমাণ পর্যালোচনাপূর্বক পুনর্নির্ধারণ, মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় বাড়ানো, নির্বাচনী প্রচারণার সময় কমানো, প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করা, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্নের কপি জমা দেওয়ার বিধান এবং ব্যানার, তোরণ ও পোস্টারের পরিবর্তে লিফলেট, ভোটার-প্রার্থী মুখোমুখি অনুষ্ঠান, পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও সরকারি গণমাধ্যমে প্রচারের সমসুযোগ দেওয়ার বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলেছে সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যালট বা অনলাইন ভোটিং চালু করার কথা বলা হয়েছে। তবে কমিশন মনে করে, এগুলো করা সময়সাপেক্ষ; কিন্তু শুরু করা প্রয়োজন।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে সরাসরি ভোট, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রেও কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এগুলো মূলত সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিষয়। ওই কমিশনও এসব বিষয়ে কাছাকাছি সুপারিশ করেছে।