উপাত্ত স্থানীয়করণ নীতিতে শিথিলতা, তবে উদ্বেগের জায়গাগুলো থাকছে

দেশেই উপাত্ত মজুত ও স্থানীয়করণে বাধ্যবাধকতা, নির্বাহী বিভাগের অগাধ ক্ষমতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অব্যাহতি, মানবাধিকার ও বাক্স্বাধীনতার ঝুঁকির মতো অনেকগুলো নীতি নিয়ে তৈরি হতে যাচ্ছিল উপাত্ত সুরক্ষা আইন। উপাত্ত স্থানীয়করণ নীতি নিয়ে ব্যবসায়ীমহল থেকে শুরু করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আপত্তি জানিয়েছিল। নতুন খসড়ায় স্থানীয়করণ নীতিতে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়েছে। তবে উদ্বেগের বাকি জায়গাগুলো থেকেই যাচ্ছে।

আজ মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে নাগরিক সমাজের সঙ্গে এক বৈঠক হচ্ছে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) আইনটি প্রণয়ন করছে।

উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২৩ এ সংশোধিত খসড়ায় যে পরিবর্তনটুকু এসেছে তা হচ্ছে, ধারা ৪৫ এর বিধান সাপেক্ষে, সংবেদনশীল উপাত্ত, ব্যবহারকারী সৃষ্ট উপাত্ত ও শ্রেণিবদ্ধকৃত উপাত্ত, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশে মজুত করতে হবে।

অন্যদিকে ধারা ৪৫ এ বলা আছে, কোনো উপাত্ত আন্ত: রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বা সরকার কর্তৃক নির্দিষ্টকৃত অন্য কোনো বিষয়ের প্রয়োজনে এই আইনের অধীন বাংলাদেশের বাইরে স্থানান্তর করা যাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা তাদের স্ব স্ব আইনগত বিধান অনুসরণ করবে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, উপাত্তধারীর প্রয়োজনে তার কোনো সংবেদনশীল উপাত্ত ও ব্যবহারকারী সৃষ্ট উপাত্তসহ যেকোনো উপাত্ত, তার সম্মতিতে ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, দেশের বাইরে অন্য কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থায়, অথবা আন্তর্জাতিক সংস্থায় স্থানান্তর করা যাবে।

আগের খসড়ায় বাংলাদেশে মজুত ও স্থানীয়করণের বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি উপাত্ত স্থানান্তরে সরকার বা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমতির নেওয়ার বাধ্যতামূলক ছিল। ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পক্ষ এ নীতিকে ব্যবসা পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এবং উপাত্তে নজরদারির ও মত প্রকাশের ঝুঁকির কথা জানিয়েছিল সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খসড়ায় ধারা ৭১–এ আইন প্রয়োগে আন্ত:রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সরকার প্রয়োজনে অন্য কোনো রাষ্ট্র বা বহু পাক্ষিক সংস্থা বা কনসোর্টিয়ামে যোগদান করতে পারবে।

উপাত্ত সুরক্ষার নীতিতে ৫ ধারায় নতুন দুটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা আছে, এই আইনের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ ও স্থানান্তরের ক্ষেত্রে অবশ্যই ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুরক্ষা-ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তির সব শর্ত মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের যদি অতিরিক্ত কোনো নির্দেশনা থাকে সেটাও অনুসরণ করতে হবে।

এ ছাড়া সব উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ ও স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তির সব মানদণ্ড অনুসরণসহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রায়োগিক সহযোগিতার শর্তও মানার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এবারের খসড়ায় সংজ্ঞায় ‘বাণিজ্যিক উপাত্ত’ যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ অর্থ সংগৃহীত বা অন্য কোনোভাবে প্রক্রিয়াকৃত ক্রেতা বা ভোক্তা সম্পর্কিত কোনো ব্যবসায়িক উপাত্তকেই বোঝানো হয়েছে।

উদ্বেগের জায়গাগুলো থেকে যাচ্ছে

উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক প্রয়োজনীয় উপাত্ত সরবরাহ করার জন্য নিয়ন্ত্রক, প্রক্রিয়াকারী বা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে নির্দেশ দিতে পারবেন। তাঁরা এ নির্দেশনা পালনে বাধ্য থাকবেন।

আইনের ৪ ধারায় প্রয়োগের ক্ষেত্রে বলা আছে, বাংলাদেশের বাইরে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিকদের উপাত্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবহার, বিতরণ বা ধারণ করা হলেও তা এ আইনের অন্তর্ভুক্ত হবে।

এর আগে গত ১০ আগস্ট জাতিসংঘ উপাত্ত সুরাক্ষা আইন নিয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল আইসিটি বিভাগে। সেখানে এই ধারা (ধারা–৪) সম্পর্কে বলেছিল, প্রবাসী কারও উপাত্ত নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আইন প্রয়োগে চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।

খসড়ায় ধারা ১০–এ বলা আছে, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বা অপরাধ প্রতিরোধ, শনাক্ত ও তদন্ত করার উদ্দেশ্যে উপাত্তধারীর কাছ থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা যাবে। এসব বিষয়ে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের জন্য এ আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানের প্রয়োগ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ধারা ৩৪–এ অধিকতর অব্যাহতি প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা কোনো নিয়ন্ত্রককে এ আইনের কোনো বিধানের প্রয়োগ হতে অব্যাহতি দিতে পারবে।

জাতিসংঘের ওই পর্যবেক্ষণে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, এই ধারা (১০) বলবৎ হলে বাংলাদেশের ডেটা সেন্টার এবং সার্ভারগুলোতে সংরক্ষিত উপাত্ত নজরদারির আওতায় আসবে। এ ছাড়া অন্যান্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে গোপনীয় তথ্য প্রকাশে চাপ সৃষ্টি করবে। এই ধারা গণতান্ত্রিক শাসনকে দুর্বল করতে পারে।

সরকার থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সি গঠনের সুপারিশ এসেছিল দেশের ও বাইরের সংস্থাগুলো থেকে। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকার পৃথক এজেন্সি গঠন করবে। সরকারই জনবল নিয়োগ দেবে। এ ছাড়া সরকার প্রয়োজনে মহাপরিচালকের কাছে এ আইনের অধীন সম্পাদিত যে কোনো বিষয়ে প্রতিবেদন বা বিবরণী আহ্বান করতে পারবে এবং মহাপরিচালক তা সরবরাহ করবেন।

এ আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘিত হলে তিনি সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন না। তাকে উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। মহাপরিচালক তদন্ত সাপেক্ষে যদি মনে করেন অপরাধ হয়েছে, তবে মহাপরিচালকই মামলা দায়ের করতে পারবেন।

৬৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে, এজেন্সির মহাপরিচালককে প্রয়োজনীয় যে কোনো নির্দেশ প্রদান করতে পারবে। মহাপরিচালক সে নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকবেন।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম যত বেশি অনলাইনে কেন্দ্রিক হচ্ছে তথ্যের গোপনীয়তা এবং উপাত্তের সুরক্ষার গুরুত্বও ততটা বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল উপাত্ত সুরক্ষার নীতি করেছে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সাল থেকে উপাত্ত সুরক্ষার জন্য একটি বিধান তৈরির উদ্যোগ নেয়। আইসিটি বিভাগ গত বছরের মার্চ মাসে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া প্রথমবারের মতো মতামত প্রদানের জন্য ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করে। এখন পর্যন্ত প্রস্তাবিত আইনটির বেশ কয়েকবার সংশোধিত খসড়া প্রকাশ হয়েছে। খসড়াগুলোর ওপর দেশি বিদেশি সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন,দূতাবাস,আর্থিক সংস্থা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে মতামত ও পর্যবেকক্ষণ জানানো হয়েছে।