চট্টগ্রাম-১৬ আসনে বিএনপি–জামায়াতের ভোট টানার চেষ্টা

আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন দলের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান ও আব্দুল্লাহ কবির।

মোস্তাফিজুর রহমান ও মুজিবুর রহমান

মাছ ধরার ট্রলারের মাঝি পঞ্চাশোর্ধ্ব মোহম্মদ জাহাঙ্গীর। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ইউনিয়নের চাঁনপুর বাজার এলাকার একটি চা দোকানে বসে খোশগল্প করছেন। নির্বাচনের মাঠ কেমন জিজ্ঞেস করতেই বলতে থাকেন, ‘আগের মতো ভোটের আনন্দ নেই। কেন্দ্রে যাওয়ার আগেই ভোট দিয়ে দেয়। গিয়ে কী লাভ।’

গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের অন্তত ১৬ জন ভোটারের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের সবার কথা প্রায় একই, ‘কেন্দ্রে গিয়ে কী হবে।’ বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এই আসনে কেন্দ্রে ভোটার আনতেই মরিয়া প্রচারণায় থাকা তিন প্রার্থী। তাঁদের নজরও মূলত বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের ভোট টানা। কারণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা তিন প্রার্থীই আওয়ামী লীগ ঘরানার। ফলে নিজেদের ভোট ভাগাভাগি হবে। তাই দলের বাইরের ভোট টানতেই যত চেষ্টা।

বাঁশখালীকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। একটাই বার্তা, কেউ কেন্দ্র দখল করতে পারবে না।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ

এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তিনি গত দুবারের (২০১৪ ও ২০১৮) সংসদ সদস্য। কেন্দ্রীয় নেতাকে নিয়ে ‘অশালীন’ মন্তব্য, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মিছিলসহ নানা কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। এবার নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় মামলা করেছে নির্বাচন কমিশন। সর্বশেষ বাঁশখালী থানার ওসি তোফায়েল আহমেদকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।

আরও পড়ুন

গত দুবার প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও এবার দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ঈগল প্রতীকের মুজিবুর রহমান ও ট্রাক প্রতীকের আব্দুল্লাহ কবির। এর মধ্যে মুজিবুর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও আব্দুল্লাহ কবির দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।

১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে এই আসন। ভোটার রয়েছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৭৮ জন। স্বাধীনতা–পরবর্তী ১১টি নির্বাচনে এই আসনে চারবার (২০১৪ ও ২০১৮সহ) আওয়ামী লীগ, পাঁচবার বিএনপি ও দুবার জাতীয় পার্টি জয়ী হয়।

বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এই আসনে কেন্দ্রে ভোটার আনতেই মরিয়া প্রচারণায় থাকা তিন প্রার্থী। তাঁদের নজরও মূলত বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের ভোট টানা। কারণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা তিন প্রার্থীই আওয়ামী লীগ ঘরানার। ফলে নিজেদের ভোট ভাগাভাগি হবে।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন প্রার্থীই বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের ভোটকেন্দ্রে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি-জামায়াতের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে না থাকলেও তাঁদের মাধ্যমে পরিবারের লোকজনের সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় আছেন। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনদেরও কাজে লাগাচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করে বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকার এক বিএনপি নেতা বলেন, পুলিশি গ্রেপ্তার এড়াতে দলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী এলাকাছাড়া। কিন্তু যাঁরা সমর্থক আছেন, তাঁদের নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়েছে। তাঁদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান বলেন, ভোটের প্রচারণায় অংশগ্রহণ করায় অনেক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সমর্থকদেরও যাতে কেউ ভোটকেন্দ্রে নিতে না পারে, নেতা-কর্মীরা সতর্ক থাকবেন।

বিএনপি-জামায়াতের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে না থাকলেও তাঁদের মাধ্যমে পরিবারের লোকজনের সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় আছেন। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনদেরও কাজে লাগাচ্ছেন।

প্রচারণায় নেই অন্য প্রার্থীরা

এই আসনে মোট প্রার্থী রয়েছেন ১০ জন। বাকি সাতজন হলেন ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের আব্দুল মালেক (চেয়ার), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) আশীষ কুমার শীল (কুঁড়েঘর), বাংলাদেশ কংগ্রেসের এম জিল্লুল করিম শরীফ (ডাব), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) মামুন আবছার চৌধুরী (আম), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহিউল আলম চৌধুরী (মোমবাতি), ইসলামী ঐক্যজোটের শফকত হোসাইন চাটগামী (মিনার) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. খালেকুজ্জামান (বেঞ্চ)। গতকাল বাঁশখালীর ১০টি এলাকায় ঘুরে মোস্তাফিজুর, মজিবুর ও আব্দুল্লাহর পোস্টার ও প্রচারণা দেখা গেছে। অন্য প্রার্থীদের কয়েকটি পোস্টার চোখে পড়লেও প্রচারণা নেই বললেই চলে।

মোস্তাফিজুরকে বেছে নেওয়ার কারণ, তিনি নৌকার প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ায় দলীয় প্রতীক দেখে অনেকে তাঁকে ভোট দিতে পারেন। এ ছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বিদ্যুৎ–সংযোগ কাছে টানতে পারে ভোটারদের।

যেসব বিষয় বিবেচনায়

ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে নৌকা ও ঈগল প্রতীকের মধ্যে।

মোস্তাফিজুরকে বেছে নেওয়ার কারণ, তিনি নৌকার প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ায় দলীয় প্রতীক দেখে অনেকে তাঁকে ভোট দিতে পারেন। এ ছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বিদ্যুৎ–সংযোগ কাছে টানতে পারে ভোটারদের। আবার বাঁশখালীর অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো বেহাল থাকায় ক্ষোভ আছে অনেকের মধ্যে।

গত দুবার প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও এবার দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ঈগল প্রতীকের মুজিবুর রহমান ও ট্রাক প্রতীকের আব্দুল্লাহ কবির।

অন্যদিকে মুজিবুর রহমানের পরিবারের ২৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বাঁশখালীর কমপক্ষে ২২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। এ ছাড়া এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে তাঁদের পরিবারের। তা ছাড়া দক্ষিণ বাঁশখালীতে তাঁর সমর্থন রয়েছে বলে আলোচনা আছে।

দুই প্রার্থীই নিজেদের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বলে জানালেন। তবে বিএনপি-জামায়াতের ভোট টানার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বলেন, বাঁশখালীকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। একটাই বার্তা, কেউ কেন্দ্র দখল করতে পারবে না।