উৎপাদন কম, আমদানি বেশি দামে

বোরো, আউশ, আমনের উৎপাদন কম। বোরো সংগ্রহও হতাশাজনক। এ অবস্থায় তিন দেশ থেকে আমদানির উদ্যোগ।

দেশে চাল নিয়ে এমন জটিল পরিস্থিতি গত এক যুগে আর তৈরি হয়নি। বোরো, আউশ ও আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বোরো ধান সংগ্রহে সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল, সেটি পূরণ হয়নি। দুই দফা শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতকে চাল আমদানির সুযোগ করে দিয়েও সুফল পাওয়া যায়নি। অনুমোদন দেওয়ার দুই মাস পর আমদানিকারকেরা ১০ শতাংশ চালও আনতে পারেননি।

এ পরিস্থিতিতে সরকার নিজেই তিনটি দেশ থেকে চাল কেনার চুক্তি করতে যাচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে সরকার চাল কিনছে বলে পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। এমনকি প্রায় একই মানের চাল প্রতি টন ভারত থেকে যে

দরে কেনা হচ্ছে, ভিয়েতনাম থেকে তার চেয়ে ৭৮ ডলার বেশি দরে কেনা হচ্ছে। সাধারণভাবে দুই দেশের মধ্যে চালের দামের পার্থক্য ২০ থেকে ৪০ ডলার হয়ে থাকে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই শেষে ভিয়েতনাম, ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে ৬ লাখ ৩০ হাজার টন চাল কিনতে মন্ত্রিসভার ক্রয় কমিটি অনুমোদন দিয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পাক্ষিক খাদ্যপরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্টের শেষের দিকে ভারতে চালের রপ্তানিমূল্য ছিল ৩৭৫ ডলার এবং পাকিস্তানে ৩৯৪ ডলার। এ ছাড়া ভিয়েতনামের চাল ৩৮৫ ডলার এবং থাইল্যান্ডের চাল ৪০০ ডলারের নিচে ছিল।

বিদেশ থেকে বাড়তি দামে চাল কেনা এবং ভিয়েতনাম ও ভারতের চালের দামের পার্থক্য ৭৮ ডলার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের বাজার এখন অস্থিতিশীল। কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে অনেক যাচাই-বাছাই শেষে সরকার কম দামেই চাল-গম কিনছে।

খাদ্য কেনায় এ ধরনের অভিযোগ আগেও উঠেছিল। তবে দেশের এ সংকটময় মুহূর্তে সবচেয়ে কম দামে খাদ্য কেনা উচিত।
এ এম এম শওকত আলী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও কৃষিসচিব

খাদ্যসচিব উল্টো অভিযোগ করেন, যাঁরা বেশি দামে সরকার চাল-গম কিনছে বলে বলছেন, তাঁদের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমত, যাঁরা সরকারের চাল আমদানির ক্ষেত্রে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তাঁরা এমন অভিযোগ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে তাঁদের ধারণা কম। তৃতীয়ত, সরকার এমন জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কম দামে বিদেশ থেকে খাদ্য আনছে, এটি তাঁরা সহ্য করতে পারছেন না।

এর আগে সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে টনপ্রতি ৫০ ডলার বেশি দামে রাশিয়া থেকে গম আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়।

খাদ্যের মজুত পর্যাপ্ত

স্বস্তির খবর হচ্ছে, খাদ্যগুদামে সরকারের চাল-গমের মজুত ভালোই আছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গুদামে ১৭ লাখ ৪৪ হাজার টন চাল এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার টন গম মজুত রয়েছে। এরই মধ্য তড়িঘড়ি বেশি দামে চাল কেনার প্রক্রিয়া শুরু করায় প্রশ্ন উঠেছে।

কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং সরকারের শীর্ষ মহলের আশঙ্কা, বোরো, আউশ ও আমনে ফলন কম হওয়ায় এবার নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে চালের দাম বাড়তে পারে। তাই বাড়তি মজুত গড়ে তুলতে সরকার ১০ লাখ টন চাল ও গম আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে।

তিন ফসলেই ফলন কম

চলতি বছর বোরো মৌসুমে হাওরাঞ্চলে তিন দফা বন্যার কারণে বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়। উপকূল ও উত্তরাঞ্চলে হঠাৎ অতিবৃষ্টির কারণেও মাঠে পাকা ফসল নষ্ট হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, বোরোতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ লাখ টন ফলন কম হয়েছে। আউশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে ২০ লাখ ৫০ হাজার টন।

অন্যান্যবারের তুলনায় এবার প্রায় ৪০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে আমনের ফলন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আগামী নভেম্বর থেকে আমন ধান কাটা শুরু হবে।

নওগাঁর ধানের আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নীরদ বরণ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। এবার আমনেও ঘাটতির শঙ্কা রয়েছে। উৎপাদন কম হওয়ায় বোরো সংগ্রহে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। মাঠপর্যায় থেকে যেসব তথ্য পাচ্ছি, তাতে আমনের মানও এবার ভালো হবে না। ফলে চালের মজুত বাড়াতে সরকারকে আমদানি করতে হবে।’

সংগ্রহ কম, বেসরকারি আমদানিতে ভাটা

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বোরো ধান সংগ্রহ মৌসুমে সরকার সাড়ে ৬ লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। বিপরীতে ২ লাখ ৬২ লাখ টন ধান সংগ্রহ করেছে। তবে ১১ লাখ টন চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা অনেকটাই পূরণ হয়েছে।

চালের সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় সরকার গত ২০ জুলাই ৩৮০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বেসরকারি খাতে মাত্র ৯৩ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে।

গত ২৮ আগস্ট চাল আমদানির শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করে সরকার। শর্ত সাপেক্ষে অন্যান্য শুল্কও কমায়। কিন্তু এরই মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাসমতী ছাড়া অন্যান্য চাল রপ্তানিতে নতুন করে শুল্ক ২০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে ভারত থেকে চাল আমদানিতে জটিলতা দেখা দেয়।

সরকার কিনছে বেশি দামে

দেশের অন্যতম চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মজুমদার ট্রেডার্স গত জুলাইয়ে ভারত থেকে আমদানির ৫০ হাজার টন চাল সরকারকে সরবরাহ করেছে। তারা ভারত থেকে আরও ৫০ হাজার টন চাল আনছে। সেখানেও পরিবহন খরচসহ দাম পড়ছে প্রায় ৪০০ ডলার।

দেশের শীর্ষস্থানীয় তিন আমদানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মূলত ৩৮০ থেকে ৪০০ ডলারে চাল আনছেন। চলতি মাসেও যেসব প্রতিষ্ঠান চাল আমদানির ঋণপত্র খুলেছে, তারাও ৪০০ ডলারে কিনছে। অথচ সরকার জিটুজি পর্যায়ে ভারত থেকে ৪৬৫ ডলারে চাল কিনছে। এতে বেসরকারি খাতের ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে চাল এনে পোষাতে পারছেন না।

মজুমদার ট্রেডার্সের মালিক চিত্ত মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থার কাছ থেকে আমাদের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কেন চাল কিনছে, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।’

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভিয়েতনাম থেকে সেদ্ধ চাল প্রতি টন ৫২১ ডলার ও আতপ চাল ৪৯৪ ডলার দরে কেনা হচ্ছে। ভিয়েতনামের রাষ্ট্রীয় সংস্থা ভিনা-২ থেকে চাল কেনার প্রক্রিয়া চলছে। ভিয়েতনাম নিজের দেশ থেকে আতপ চাল দেবে। আর সেদ্ধ চাল থাইল্যান্ড থেকে কিনে বাংলাদেশে রপ্তানি করবে।

ভিনা-২–এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ও শাহনেওয়াজ ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভিয়েতনামের চালের মান ভালো। আর বিশ্ববাজারে চালের বাজার অস্থির। বাংলাদেশ যাতে নিশ্চিতভাবে চাল পায়, সে জন্য ওই দামে চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে।

থাইল্যান্ড থেকে সেদ্ধ চাল কিনে বাংলাদেশে রপ্তানির বিষয়ে সাদ আহমেদ বলেন, বিষয়টি সরকারের সঙ্গে ভিনা-২–এর চুক্তিতেই আছে।

তৃতীয় দেশের মাধ্যমে থাইল্যান্ড থেকে চাল কেনা প্রসঙ্গে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল বলেন, ‘থাইল্যান্ডের কাছ থেকে চাল কিনতে কয়েক দফা তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা সাড়া না দেওয়ায় ভিয়েতনামের মাধ্যমে চাল কেনা হচ্ছে।’

মিয়ানমারের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কৃষকদের সমবায় সংগঠন মিয়ানমার রাইস ফেডারেশন (এমআরএফ) থেকে প্রতি টন ৪৬৫ ডলার করে আতপ চাল কেনার চুক্তি হতে যাচ্ছে।

ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থা কেন্দ্রীয় ভান্ডার থেকে প্রতি টন ৪৪৩ দশমিক ৫০ ডলার করে চুক্তি করছে সরকার। দেশটির আরেক রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে সেদ্ধ চাল ৪৬৫ ডলার করে কেনা হচ্ছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্য কেনায় এ ধরনের অভিযোগ আগেও উঠেছিল। তবে দেশের এ সংকটময় মুহূর্তে সবচেয়ে কম দামে খাদ্য কেনা উচিত। ব্যবসায়ীরা কম দামে চাল-গম আনতে পারলে সরকার কেন বেশি দামে কিনছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।