যেভাবে ইসলামি গানে জোয়ার এনেছিল ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’

আব্বাসউদ্দীন আহমদ তত দিনে দু-একখানা গান রেকর্ড করে নাম করে ফেলেছেন। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শুরু। কোচবিহার কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলেন। বৃহত্তর জীবনের অনাগত দিনগুলো যেন হাতছানি দিয়ে তাঁকে ডাকছিল। আর সে ডাক তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন। তাই অভিভাবকের অনুমতি না নিয়েই কলকাতা চলে গেলেন। কিছু অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ মিলল। তত দিনে (১৯৩২) গ্রামোফোন কোম্পানিতে দুটি গান রেকর্ডও হয়ে গেল। একটি ছিল শৈলেন রায়ের লেখা ‘আজি শরতের রূপ দীপালি’, আরেকটি জীতেন মৈত্রের লেখা, ‘ওলো প্রিয়া নিতি আসি তব দ্বারে মন-ফুল-মালা নিয়া।’

এরই মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে, কোচবিহারে দুটি অনুষ্ঠানে। বয়সে আব্বাসউদ্দীন দুই বছরের ছোট (নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালে, আব্বাসউদ্দীনের ১৯০১)। অনেকটা বড় ভাই-ছোট ভাই সম্পর্ক। নজরুলকে কাজীদা বলে ডাকতেন আব্বাসউদ্দীন। এর মধ্যে নজরুলের ‘বেনুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধর’, ‘গাঙে জোয়ার এল, ফিরে তুমি এলে কই’, ‘বন্ধু আজও মনে পড়ে আম কুড়ানো খেলা’ এগুলোসহ আরও কয়েকটি গান রেকর্ড করলেন। বেশ নাম হলো আব্বাসউদ্দীনের। তবু কেন যেন মনে প্রশান্তি লাভ করতে পারছিলেন না তিনি।

আধঘণ্টায় লেখা ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...’

তখন বাংলার মুসলমান সমাজে কাওয়ালি খুব জনপ্রিয়। পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়ালের কাওয়ালির রেকর্ড বিক্রি হয় হাজারে হাজারে।

একদিন আব্বাসউদ্দীনের মাথায় ভাবনা এল, বাংলায় যদি এ রকম ইসলামি গান দেওয়া যেত, কেমন হতো? কথাটা তিনি তাঁর কাজীদার কাছে পাড়লেন, এ–ও বললেন, ‘আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

কথাটা নজরুলের মনে ধরল। তিনি বললেন, ‘আব্বাস, তুমি ভগবতীবাবুকে বলে তাঁর মত নাও। আমি ঠিক বলতে পারব না।’

ভগবতীবাবু তখন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ইনচার্জ। আব্বাসউদ্দীন তাঁকে কথাটা বলতেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘না না না, ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।’

কাজী নজরুল ইসলাম দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার মধ্যেই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ।’ তখনই সুর সংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন আব্বাসকে।

এরপর ছয় মাস কেটে গেল। গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল রুমে ভগবতীবাবু এক নারীর সঙ্গে খোশগল্প করছিলেন। আব্বাসউদ্দীন ঢুকে নমস্কার জানালেন। মনে মনে ভাবলেন, ভগবতীবাবুর এখন মন ভালো আছে। ইসলামি গানের কথাটা আবার তোলা যাক। বললেন, ‘সেই যে বলেছিলাম ইসলামি গান দেওয়ার কথা, আচ্ছা, একটা এক্সপেরিমেন্ট করুন না। যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী?’ ভগবতীবাবু হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা করা যাবে।’

আব্বাসউদ্দীন শুনলেন, পাশের ঘরেই কাজীদা ছিলেন। তাড়াতাড়ি কাজীদাকে বললেন, ভগবতীবাবু রাজি হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা নজরুলের কাছে গান শিখছিলেন। নজরুল বললেন, ‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে।’ আব্বাসউদ্দীন অফিসের সহকারী দশরথকে এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললেন। তারপর কাজী নজরুল ইসলাম দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার মধ্যেই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ।’ তখনই সুর সংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন আব্বাসকে।

পরদিন আবার আব্বাসকে আসতে বললেন। লিখলেন, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর।’

আব্বাসউদ্দীন আহমদ

তখনকার দিনে গানের যন্ত্র বলতে ছিল হারমোনিয়াম আর তবলা। গান দুটি তখনো আব্বাসউদ্দীনের মুখস্থ হয়নি। মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর নজরুল নিজেই সেই গানের কাগজখানা ধরলেন। আব্বাসউদ্দীন গেয়ে চললেন। গান লেখার ঠিক চার দিন পরেই রেকর্ড হলো। তখন থেকে দুই মাস বাকি ছিল ঈদুল ফিতর। ঠিক হলো ঈদে এই রেকর্ড বাজারে আসবে।

সন্দেশ, রসগোল্লা আর চা এল

ঈদের ছুটিতে কোচবিহারের বাড়িতে গেলেন আব্বাসউদ্দীন। একদিন কলকাতা ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিসে যাচ্ছেন। তাঁর পাশে বসে এক যুবক গুনগুন করে গাইছে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। আব্বাসউদ্দীন একটু অবাক হলেন। ও এই গান শুনল কী করে!

অফিস ছুটির পর গড়ের মাঠে বেড়াতে গেলেন আব্বাস। মাঠে একদল ছেলের মাঝে একটি ছেলে গেয়ে উঠল, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। তখন আব্বাসের মনে হলো, আরে, এ গান তো ঈদের সময় বাজারে বের হওয়ার কথা!

তখন ইসলামি গানের এত বেশি চাহিদা তৈরি হলো যে আব্বাসউদ্দীন একা আর গেয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। প্রতি মাসেই তাঁর রেকর্ড বের হয়। তকরীম আহমদ, আবদুল লতিফ নামে নতুন শিল্পীরাও গেয়ে জনপ্রিয় হলেন।

আব্বাস সোজা চলে গেলেন বি এন সেন অর্থাৎ সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির বিভূতিভূষণ সাহার দোকানে। আব্বাসউদ্দীন ঈদের ছুটিতে কোচবিহার যাওয়ার আগে ফটোগ্রাফার ডেকে তাঁর ছবি তুলিয়ে রেখেছিলেন এই বিভূতি। দোকানে যেতেই আব্বাসকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। সন্দেশ, রসগোল্লা আর চা এল। আব্বাসউদ্দীনের গান দুটো আর আর্টপেপারে ছাপানো বিরাট ছবির বান্ডিল সামনে রেখে বললেন, ‘বন্ধুবান্ধবের কাছে বিলি করে দিয়ো। আমি সত্তর-আশি হাজার ছাপিয়েছি। ঈদের দিন এসব বিতরণ করেছি। আর এই দেখো, দুই হাজার রেকর্ড এনেছি তোমার।’

আনন্দে-খুশিতে মন ভরে উঠল আব্বাসউদ্দীনের। গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল রুমে ঢুকে পড়লেন। গলা শুনেই একদম লাফিয়ে উঠে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন নজরুল। ‘আব্বাস, তোমার গান কী যে...’ আর বলতে না দিয়ে নজরুলকে কদমবুসি করলেন। ভগবতীবাবুকে বললেন, ‘তাহলে এক্সপেরিমেন্টের ধোপে টিকে গেছি, কেমন? তিনি বললেন, ‘এবার তাহলে আরও কখানা এই ধরনের গান...’ সবকিছুর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলেন আব্বাসউদ্দীন।

ধীরেন দাস যখন গনি মিঞা

এরপর নজরুল লিখে চললেন একের পর এক ইসলামি গান। ‘আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়’, ‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি’।

তখন ইসলামি গানের এত বেশি চাহিদা তৈরি হলো যে আব্বাসউদ্দীন একা আর গেয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। প্রতি মাসেই তাঁর রেকর্ড বের হয়। তকরীম আহমদ, আবদুল লতিফ নামের নতুন শিল্পীরাও গেয়ে জনপ্রিয় হলেন। তারপরও যেন ইসলামি গানের চাহিদা শেষ হয় না। এই ইসলামি গানই গ্রামোফোন কোম্পানির ঘরে এনেছিল অর্থের প্লাবন। তাই মুসলমান গায়কের অভাব বলে ধীরেন দাস সাজলেন গনি মিঞা, চিত্ত রায় সাজলেন দেলোয়ার হোসেন, আশ্চর্যময়ী, হরিমতী—তাঁরা কেউ সাজলেন সকিনা বেগম, আমিনা বেগম, গিরীন চক্রবর্তী সাজলেন সোনা মিঞা।

এর মধ্যে সবচেয়ে ফ্যাসাদ হলো কে মল্লিক নামের একজন শিল্পীকে নিয়ে। ওই সময় তিনি শ্যামাসংগীতের জনপ্রিয় গায়ক। ধর্মে তিনি মুসলমান। কিন্তু লোকে মনে করত তিনি হিন্দু। কে মল্লিক একদিন আব্বাসউদ্দীনের কাছে অনুরোধ করে বসলেন, তিনিও নজরুলের দুখানা ইসলামি গান গাইতে চান। নজরুলও লিখতে রাজি হলেন। কিন্তু সেই ভববতীবাবু একেবারেই গররাজি। কারণ, তাঁর মত, হিন্দুরা যখন জানতে পারবে কে মল্লিক মুসলমান, তখন তারা আর মল্লিকের শ্যামাসংগীতের রেকর্ড কিনবে না।

এই টানাপোড়েনের মধ্যে পরপারে চলে গেলেন ভগবতীবাবু। সে জায়গায় এলেন হেমচন্দ্র সোম। আব্বাসউদ্দীন তাঁর কাছে বলামাত্রই তিনি বললেন, ‘বেশ তো, মল্লিকমশায় বুড়ো হয়েছেন। গ্রামোফোন কোম্পানি লক্ষ লক্ষ টাকা তাঁকে দিয়ে কামিয়েছে। তিনি যদি ইসলামি গান গেয়ে আনন্দ পান, আলবত তাঁকে গাইতে দেওয়া হবে।’

সেদিন নজরুল আর কে মল্লিক যে কী খুশি হয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীনের প্রতি!

(তথ্যসূত্র: আব্বাসউদ্দীন আহমদের ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পীজীবনের কথা’। সম্পাদনা: মুস্তাফা জামান আব্বাসী। প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন)