ভারত তো বিশ্বের অন্যতম খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় খাদ্যের বড় অংশ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। হঠাৎ রপ্তানিতে ভাটা নামল কেন?
সিরাজ হুসাইন: ভারতের আবহাওয়া এ বছরের প্রায় পুরো সময় চরম বৈরী ছিল। শুধু ভারত নয়, এই অঞ্চলজুড়ে চরম বৈরী আবহাওয়া ছিল। আমাদের গ্রীষ্মকালীন ফসল, যা খরিফ ফসল। সরকারি হিসাবে চাল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, ডাল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, ভোজ্যতেল ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ, সয়াবিন তেল ২৩ শতাংশ কম উৎপাদিত হয়েছে।
এবারের জুনে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি। জুলাইয়ে আবার বেশি বৃষ্টি হয়েছে। গত মার্চে ভারতের ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল। এতে অনেক এলাকায় ফসল পুড়ে গেছে। এতে গ্রীষ্মকালীন ফসলের উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে সরকারকে অভ্যন্তরীণ বাজারে এসব খাদ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হচ্ছে। এতে রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতকে রক্ষণশীল হতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্যঘাটতি বা উৎপাদন কম হওয়ার বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। কিন্তু খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা দেখে বোঝা যাচ্ছে সরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং দাম নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
ফসল উৎপাদন কম হওয়ায় ভারত এবার রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রেখেছে।
দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে অতিবৃষ্টি ও বেশি তাপমাত্রা কৃষিতে বড় সমস্যা।
খাদ্যপণ্যের নতুন জাত উদ্ভাবনে অব্যাহতভাবে কাজ করতে হবে।
ভারতের কৃষিপণ্য রপ্তানি কোটায় বাংলাদেশের নাম না দেখে আশ্চর্য হয়েছি।
এসব খাদ্যপণ্যের উৎপাদন কম হওয়ায় ভারতকে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছে?
সিরাজ হুসাইন: সামগ্রিকভাবে ভারতে অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি হয়। বাড়তি খাদ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি করা হয়। এই রপ্তানি ক্রমাগত বাড়ছিল। কিন্তু চলতি বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন কম হলেও দেশের বাজারে এর খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। যেমন ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার ৬৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়েছে। তবে এতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। কারণ, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমতির দিকে। কেন্দ্রীয় সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে বেশ সফল হয়েছে বলা যায়।
ডাল নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা আছে। কারণ, ভারতীয়রা প্রচুর ডাল খায়। তারা যে ধরনের ডাল খায়, সেটার দাম বাড়ছে। মোজাম্বিক, মালাউ ও মিয়ানমারের সঙ্গে ডাল আমদানির চুক্তি করেছে। এসব দেশের ডাল দেশে আসা শুরু করলে আশা করি সমস্যা হবে না।
বাংলাদেশের কৃষি খাতকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
সিরাজ হুসাইন: বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হয়েও খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়েছে। প্রয়োজনীয় খাদ্যের বড় অংশ দেশেই উৎপাদন বড় সাফল্য। বিশেষ করে খাদ্যের নতুন জাত উদ্ভাবন ও তা কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য লক্ষণীয়। তবে হ্যাঁ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভারতের মতো বাংলাদেশের ওপরেও পড়ছে।
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষিতে আবহাওয়ার বৈরী আচরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেক বেশি। কারণ, বাংলাদেশের কৃষিজমির পরিমাণ খুবই কম। সেখানে প্রতিবছর বন্যা হয়, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। আবার অতিরিক্ত তাপমাত্রা লক্ষ করা যাচ্ছে। আবহাওয়ার এই আচরণ ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে।
ভারতের কৃষি নিয়ে আলোচনা উঠলেই কৃষক আন্দোলনের কথা আসে। সেই তেভাগা থেকে শুরু করে কয়েক বছর ধরে নানা দাবিতে কৃষকদের পায়ে হেঁটে দিল্লি পর্যন্ত লংমার্চ আন্দোলন আলোচিত হয়েছে।
সিরাজ হুসাইন: ভারত ঐতিহাসিকভাবে কৃষিনির্ভর দেশ। এখনো দেশের ৪৫ শতাংশ মানুষের জীবন–জীবিকা কৃষিনির্ভর। কৃষক থেকে শুরু করে কৃষিমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষিপণ্য পরিবহন, খুচরা ও পাইকারি ক্রেতা–বিক্রেতা এবং রপ্তানি বাজারের বড় অংশ কৃষি ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। ভারতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বেশ বড়। তবে শুধু কৃষকের কথা বললে, এখানে তাঁদের অবস্থা খুব ভালো বলা যাবে না। এখন পর্যন্ত মাথাপিছু জমির পরিমাণ ১ দশমিক ১ হেক্টর। পশ্চিমবঙ্গে জমি আরও কম—দশমিক ৫ হেক্টর। এত ছোট ছোট খামার আর বিপুলসংখ্যক মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় চাপটা খুব বেশি।
এ ধরনের ভূমি ব্যবস্থাপনার একটি দেশে যখন শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তখন পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। কৃষক দেখছেন, শিল্প হলে তাঁদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে তাঁরা শিল্পের বিরোধিতা করছেন। পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে আমরা এমন জটিলতা দেখেছি। সেখানে কৃষকেরা কৃষিজমি রক্ষায় আন্দোলন করেছেন। ভারতের অন্যান্য এলাকায় এমন চিত্র দেখা গেছে।
ভারতে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে তাহলে কী হবে?
সিরাজ হুসাইন: শিল্পকারখানা তো হতেই হবে। নতুন নতুন শিল্প গ্রুপ বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে। বিদেশি বিনিয়োগও আসছে। যেমন নন্দীগ্রামে টাটা এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল। আন্দোলনের মুখে তা হয়নি। একই এলাকায় এখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মাইক্রো চিপস কারখানা হয়েছে। এতেও বিনিয়োগ এক বিলিয়ন ডলার। প্রশ্ন হচ্ছে যেখানকার কৃষিজমিতে কারখানা হবে, সেখানকার কৃষকদের পরিকল্পিতভাবে অন্য খাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এটি না করলেই সমস্যা তৈরি হবে।
যেমন ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ভারতে নির্মাণ খাতের একটি উল্লম্ফন হয়েছে। সেখানে প্রচুর কৃষকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকার সাধারণ নাগরিকদের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চাভিলাষী একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। শিল্প ও সেবা খাতের উপযোগী জনবল তৈরি করতে সরকার বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে নির্মাণ খাতও পড়েছে। কৃষকদের দক্ষতা বাড়ানোয় শুধু দেশে না, বিদেশেও তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এসব উদ্যোগ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এককভাবে কৃষির ওপর থেকে চাপ কমাচ্ছে।
ভারতে কৃষিতে সরকারের বিনিয়োগ কেমন?
সিরাজ হুসাইন: ভারত সরকার কৃষিতে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছে। যেমন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মতো রাজ্যে ৯৫ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছে। মহারাষ্ট্রসহ এসব রাজ্যে সেচ অবকাঠামো না গড়লে ফসল ফলানো কঠিন হতো। এখন অতিরিক্ত তাপমাত্রা আমাদের কৃষির জন্য বড় বিপদ তৈরি করছে। কম বৃষ্টি ও বেশি গরমের কারণে জমিতে বেশি সেচ দিতে হচ্ছে। এতে ভূগর্ভের পানির স্তর আরও নেমে যাচ্ছে। এসব নতুন সমস্যা নিয়েও সরকার ভাবছে।
ভারতের কৃষকদের আত্মহত্যার বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচিত। কৃষির এত উন্নতির পরেও কেন এসব ঘটছে? কৃষিঋণ না কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া? কোনটা এ ক্ষেত্রে দায়ী?
সিরাজ হুসাইন: আসলে কৃষকদের আত্মহত্যার বিষয়টি কোনো একটি সুনির্দিষ্ট কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। প্রথমত, মনে রাখতে হবে, কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে দেখা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওডিশার মতো দরিদ্র রাজ্যগুলোতে কৃষকদের আত্মহত্যা কম। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানার মতো রাজ্যে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এসব রাজ্যে শুধু কৃষকই নয়, অন্য শ্রেণি–পেশার মানুষের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। যেমন এসব রাজ্যের যেসব শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় না, তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
আরেকটি বিষয় খেয়াল করুন, সব ধরনের কৃষক নয়, মূলত তুলাচাষিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। তুলা চাষে মুনাফা যেমন বেশি, বিনিয়োগও তেমনি বেশি করতে হয়। এ জন্য যেসব কৃষি উপকরণ লাগে, সেগুলোর দামও বেশি। কিন্তু তুলা চাষে পোকার আক্রমণ, খরা, দাম কমে যাওয়ার মতো সমস্যা নিয়মিত দেখা যায়।
সাধারণভাবে কৃষকেরা তুলা চাষে বিনিয়োগের অর্থ কোথা থেকে পান। কৃষক সরকারিভাবে কী পরিমাণ ঋণ পান?
সিরাজ হুসাইন: ভারতের ৬০ শতাংশ কৃষক সরকারি ঋণ পান। সাধারণভাবে স্বল্প সুদে—মাত্র ৩ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়। অনেক রাজ্যে বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হয়। সমস্যাটা ঋণ পাওয়া নিয়ে নয়। ঋণের অর্থ কৃষকেরা কীভাবে ব্যবহার করছেন, সেটা বড় বিষয়। যেমন একজন কৃষক এক লাখ রুপি ঋণ নিলেন। এর মধ্যে ৩০ হাজার রুপি তিনি ভোগ্যপণ্য কেনায় ব্যয় করলেন। কিন্তু চাষের সময় যখন অর্থ দরকার হয়, কৃষক তখন মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ফলে কৃষক মহাজনের ওই ঋণচক্রে পড়ে যান। তুলা চাষে প্রচুর কীটনাশক দিতে হয়।
তাহলে সমস্যার সমাধান কোথায়?
সিরাজ হুসাইন: ভারতে এখন আখের চাষ সবচেয়ে টেকসই কৃষি। এর দামও খুব বেশি ওঠানামা করে না। সরকার ছাড়াও বেসরকারি খাতের অনেক উদ্যোক্তা চিনিকল স্থাপন করেছেন। তাঁরা নিয়মিত আখ কেনা ছাড়াও কৃষকদের অর্থায়ন ও উপকরণ কেনার পেছনে বিনিয়োগ করে থাকেন। রপ্তানি করায় ভারতে চিনির দাম খুব বেশি কমে না, স্থিতিশীল থাকে।
আখের নতুন জাত উদ্ভাবনেও ভারত বেশ এগিয়েছে। নতুন একটি জাত এসেছে, যা থেকে বছরে তিনবার আখ পাওয়া যায়। গত তিন বছরে এই নতুন জাতের কারণে চিনি উৎপাদনে বড় ধরনের রূপান্তর ঘটেছে। কৃষি গবেষণা একটি ধারাবাহিক ব্যাপার। বাংলাদেশের উচিত এ ধরনের আখের জাত উদ্ভাবনে মনোযোগ দেওয়া।
ভারত গত বছর শুধু বাসমতী চাল রপ্তানি করে ৫০০ কোটি ডলার আয় করেছে। তুসা নামে বাসমতীর নতুন জাত এসেছে। এটা ভালো ফলন দিচ্ছে। কৃষকেরাও ভালো দাম পাচ্ছেন। কারণ, এই চালের বড় অংশ রপ্তানি হচ্ছে। ভারত সবজি, ফল ও ভুট্টা চাষেও বেশ সাফল্য পেয়েছে। বিহারের কৃষকেরা গ্রীষ্মকালীন ভুট্টার চাষ করে ভালো দাম পাচ্ছেন। ওই ভুট্টা বাংলাদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
কিন্তু ভারত চাল, গম ও চিনির মতো জরুরি পণ্য রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রেখেছে? সিঙ্গাপুর, ভুটান ও মালয়েশিয়ায় কোটার ভিত্তিতে এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ কেন ওই তালিকায় নেই?
সিরাজ হুসাইন: এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। এসব পণ্যের রপ্তানি বন্ধের পর ভারত যখন কয়েকটি দেশকে কোটার ভিত্তিতে এসব পণ্য আমদানির সুযোগ দিল, তখন আমি ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে কি না, তা খুঁজেছি। বাংলাদেশ ও নেপালের নাম ওই তালিকায় না দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি। তবে বিষয়টি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। কৃষি বা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ ক্ষেত্রে কিছু করার নেই। বাংলাদেশের উচিত, বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা। দুই দেশের কৃষি কূটনীতি বাড়াতে হবে।
প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সিরাজ হুসাইন: আপনাকেও ধন্যবাদ।