বছরে ২৪ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু 

নিউমোনিয়া প্রতিরোধযোগ্য। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। দরকার সম্মিলিত প্রয়াস। 

মোহাম্মদ সহিদুল্লা,আহমেদুল কবির,নাজমুন নাহার,মায়া ভ্যানডেনেন্ট

নিউমোনিয়া এখনো শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। দেশে প্রতিবছর ২৪ হাজারের বেশি শিশু মারা যাচ্ছে নিউমোনিয়ায়। তবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব।

গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস: নিউমোনিয়া নির্মূলে চাই সমবেত উদ্যোগ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও দাতা সংস্থার কর্মকর্তারা এসব কথা বলেন। ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। আজ ১২ নভেম্বর বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস। দিবসটিকে সামনে রেখে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য  ‘নিউনোমিয়া প্রতিরোধ করুন: প্রতিটি শ্বাসই গুরুত্বপূর্ণ’।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, বাংলাদেশে অপুষ্টি, মারাত্মক সংক্রমণ, নবজাতকের ধনুষ্টংকার, অপরিণত জন্ম, জন্ডিস, জন্মকালে আঘাত, জন্মকালে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় অনেক শিশু মারা যায়। সবচেয়ে বেশি মারা যায় নিউমোনিয়ায়। ১৮ শতাংশ শিশুমৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। নিউমোনিয়া প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তারপরও বছরে ২৪ হাজার ৩০০ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে এই রোগে।

নবজাতকের স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় কারিগরি ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতি ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘অন্যায় হবে যদি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত কোনো শিশু অক্সিজেন–সংকটের কারণে মারা যায়।’ তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডিসিএল অ্যামোক্সোসিলিন তৈরি করলে শিশুদের জীবনদায়ী এই ওষুধের সংকট কমবে। হাসপাতালে পালস্অক্সিমিটার ও নেবুলাইজার নিশ্চিত করার কথাও বলেন তিনি। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, নিউমোনিয়া একটি বিচ্ছিন্ন বিষয় বা ইস্যু নয়। স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতি না করে নিউমোনিয়া পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না। এ জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার পথে যেতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

বারডেম হাসপাতালের সাবেক মহাপরিচালক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজমুন নাহার বলেন, ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে মায়েরা হাসপাতালে বিলম্বে আসেন। এখনো মায়েরা হাসপাতালে বিলম্বে আসছেন। এর সুনির্দিষ্ট কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। তিনি আরও বলেন, নিউমোনিয়ায় কত শিশু মারা যাচ্ছে, তার একটি হিসাব জানা গেলেও কত শিশু আক্রান্ত হচ্ছে, তার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মায়া ভ্যানডেনেন্ট বলেন, বাংলাদেশ শিশুমৃত্যু কমিয়েছে, নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুও কমিয়েছে। এখনো যে মৃত্যু হচ্ছে, তা প্রতিরোধযোগ্য। তবে এই কাজ স্বাস্থ্য বিভাগের একার নয়। ওয়াশ, এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং, পরিবেশ দূষণজনিত সমস্যা– সবকিছুই বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা জোরদার করতে ও হাইপোক্সিয়ার চিকিৎসায় ইউনিসেফ সরকারকে সহযোগিতা করেছে। প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ও কমিউনিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষিত ও মানসম্মত স্বাস্থ্য জনবল গড়ে তোলার ওপর জোর দেন তিনি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে গোলটেবিল বৈঠকের ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির উপপ্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. জহুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, অপুষ্টি, বায়ুদূষণ ও কম জন্ম–ওজন নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। দেশে ৫ বছরের কম বয়সী ২৮ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। ৫০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে আছে।

নিউমোনিয়া চিকিৎসায় কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে মো. জহুরুল ইসলাম আরও বলেন, নিউমোনিয়ার ওষুধ তৈরি ও বিপণনে একচেটিয়া ব্যবসা চলছে। এর অবসান হওয়া দরকার। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেয়, কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিউমোনিয়ার তথ্য পাওয়া যায় না। 

দেশে নিউমোনিয়া চিকিৎসায় যে নির্দেশিকা বা গাইডলাইন ব্যবহার করা হয়, তাতে দুর্বলতা আছে বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রজন্ম রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচিলক সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, নিউমোনিয়ার গবেষণায় বেশি অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। গবেষণার ভিত্তিতে নিউমোনিয়া মোকাবিলায় বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার কর্মসূচির ব্যবস্থাপক সাব্বির হায়দার বলেন, ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে নিউমোনিয়া বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে পালসঅক্সিমিটার আছে। ভবিষ্যতে সব কমিউনিটি ক্লিনিকে নেবুলাইজার দেওয়া হবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক নুরুল ইসলাম খান বলেন, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে যেন নিউমোনিয়ার গুরুতর রোগী পৌঁছানো মাত্রই চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয়। 

একপর্যায়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এই পরিস্থিতিকে বলে হাইপোক্সিয়া। তখন রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক মুহম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, অক্সিজেন পরিমাপের জন্য পালসঅক্সিমিটার খুবই দরকার। অক্সিজেনের পরিমাণ না জানার কারণে কোনো শিশুর যেন মৃত্যু না হয় সে ব্যাপারে বিশেষ জোর দিতে হবে। 

আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিবার–পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনবলের স্বল্পতা আছে বলে উল্লেখ করেন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, নিউমোনিয়া চিকিৎসায় যেন সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে একই নির্দেশিকা মেনে চিকিৎসা দেয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ, নবজাতক, শিশু ও কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য কর্মসূচির ভারপ্রাপ্ত লাইন ডিরেক্টর আজিজুল আলীম বলেন, এ বছরের মধ্যে নিউমোনিয়াবিষয়ক ভিত্তি তথ্য তৈরির কাজ শেষ হবে।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শামিনা শারমিন বলেন, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বর্তমানে ৫ম হেলথ সেক্টর প্রোগ্রাম তৈরি করছে। এখনি সঠিক সময় নিউমোনিয়া প্রতিরোধে একটি সম্মিলিত পরিকল্পনা তৈরি করার। মা ও শিশু স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য বিভাগ, পুষ্টি বিভাগ, টিকাদানকারী বিভাগ, কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার, পরিবেশ বিভাগ– সকলকে এক সঙ্গে একটি সম্মিলিত পরিকল্পনা করতে হবে যেন নিউমোনিয়ার প্রতিটি ঝুঁকির কারণ প্রতিহত করা যায়।

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।