নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষায় বড় পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে

ফাইল ছবি

নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হচ্ছে আগামীকাল রোববার। একই দিনে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে পড়ানোর ধরন ও মূল্যায়নব্যবস্থা পাল্টে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পাঠ্যবইও বদলে যাচ্ছে। আগামীকাল তিনটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। পরের বছর থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতে এই ব্যবস্থা চালু হবে।

অবশ্য শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়েই শুরু হচ্ছে নতুন এই শিক্ষাক্রম, তাই এর ফলাফল নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই শঙ্কা আছে। এনসিটিবির পরিকল্পনা ছিল, ডিসেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষককে পাঁচ দিনের সশরীর প্রশিক্ষণ দিয়ে জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মাধ্যমিকের শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক মাত্র এক ঘণ্টার অনলাইন প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অবশ্য মাউশি বলছে, ৬ জানুয়ারি থেকে সব শিক্ষককে পাঁচ দিনব্যাপী সশরীর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

সর্বশেষ ২০১২ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম হয়েছিল। নিয়ম হলো পাঁচ বছর পরপর শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা। কিন্তু এবার দীর্ঘদিন সময় নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে। এবারের শিক্ষাক্রমকে বলা হচ্ছে ‘যোগ্যতাভিত্তিক’, যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে এমন সব যোগ্যতা শেখানো হবে, যা সে জীবনযাপনের বাস্তব কাজে প্রয়োগ করতে পারে।

এনসিটিবির সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে। ২০২৪ সালে চালু হবে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালুর মধ্য দিয়ে পুরোপুরিভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথাগত পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত কোনো পরীক্ষাই হবে না। সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি বিষয়ের (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান) কিছু অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন, বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে। অবশিষ্ট পাঁচটি বিষয়ের পুরোটাই মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে সামষ্টিক মূল্যায়ন বেশি হবে (৭০ শতাংশ সামষ্টিক ও ৩০ শতাংশ শিখনকালীন)। সামষ্টিক মূল্যায়নও এখনকার মতো শুধু কাগজ-কলমনির্ভর পরীক্ষা হবে না। অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ, হাতে-কলমের কাজ ইত্যাদি বহুমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। এখনকার মতো জিপিএভিত্তিক ফলাফলও প্রকাশ করা হবে না। তিনটি ধাপে ফলাফল প্রকাশ করা হবে। এর মধ্যে প্রথম স্তরটিকে বলা হবে পারদর্শিতার প্রারম্ভিক স্তর। দ্বিতীয় স্তরটি বলা হবে অন্তর্বর্তী বা মাধ্যমিক স্তর। আর সর্বশেষ, অর্থাৎ সবচেয়ে ভালো স্তরটিকে বলা হবে পারদর্শী স্তর।

নতুন পদ্ধতিতে এখনকার মতো কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নও থাকবে না, এমনকি এখন যেভাবে এমসিকিউ করা হয়, তা-ও থাকবে না। বছরজুড়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন মূল্যায়ন চলতে থাকবে।

এ ছাড়া যখন নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হবে, তখন এখনকার বিভাগ বিভাজন থাকবে না, অর্থাৎ এখন যেমন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে অভিন্ন বিষয় পড়ে নবম শ্রেণিতে গিয়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভাগ করা হয়, সেটি হবে না। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে এবং উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ বিভাজন হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বইয়ের বিষয়বস্তু, বিন্যাসসহ সব ক্ষেত্রেই আনা হচ্ছে বড় রকমের পরিবর্তন। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আজ বছরের প্রথম দিনে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই হাতে পাবে। ইতিমধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবইও প্রস্তুত করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাবে।

বই উৎসব কাল

করোনার কারণে গত দুই বছর বই উৎসব হয়নি। করোনা নিয়ন্ত্রণে আসায় আগামীকাল নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

অবশ্য সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎসব হলেও বছরের প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পাবে না। নানামুখী জটিলতায় এবার ছাপার কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কয়েকটি করে বই পাবে। আজ শনিবার বিকেল পর্যন্ত প্রাথমিকের প্রায় ২৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ১৯ শতাংশের মতো বই ছাপাই হয়নি।

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম আজ প্রথম আলোকে বলেন, পাঠ্যপুস্তক উৎসবের কোনো ঘাটতি হবে না। উৎসবের জন্য সব জায়গাতেই বই গেছে এবং সব শিক্ষার্থীই নতুন বই হাতে পাবে। তবে শতভাগ বই দিতে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

এবার প্রাথমিকের ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ২৪৫টি এবং মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮৩ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি বই ছাপানো হচ্ছে। এনসিটিবির সূত্রমতে, গতকাল বিকেল পর্যন্ত প্রাথমিকে ৭ কোটি ৫০ হাজারের কিছু বেশি বই ছাপা হয়েছে। তবে ছাপার পর আনুষঙ্গিক কাজ শেষে উপজেলা পর্যায়ে গেছে ৬ কোটি ৭৭ লাখের বেশি বই। অন্যদিকে মাধ্যমিকে ১৯ কোটি ২২ লাখের বেশি বই ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে গেছে ১৭ কোটি ৭৯ লাখের বেশি বই।

সব মিলিয়ে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীকে নতুন বই দেওয়া হবে। এবার মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তক উৎসব হবে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার কাপাসিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য বই উৎসব হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন।