গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আলোচনা

সফরের প্রথম দিনে চার মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন মিশেল ব্যাশেলেত। এসব বৈঠকে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও কথা হয়।

মিশেল ব্যাশেলেত

বাংলাদেশ সফরের প্রথম দিনে গতকাল রোববার সরকারের চারজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত। এসব বৈঠকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারের নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ সে প্রস্তাব বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে।

মিশেল ব্যাশেলেত চার দিনের সফরে গতকাল ঢাকায় আসেন। এদিন তিনি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন।

এসব বৈঠকের পর রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নানা মাত্রায় আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রীরা এ সময় জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষা ও বিকাশে সরকারের আন্তরিক চেষ্টার উদ্যোগগুলো তুলে ধরেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় নিয়মিতভাবে প্রতিবেদন উপস্থাপনের জন্য মিশেল ব্যাশেলেত বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন।

তবে বিষয়টি আরও ত্বরান্বিত ও কার্যকর করতে তিনি নতুন একটি প্রক্রিয়া গঠনের প্রস্তাব করেন।

গতকাল বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মিশেল ব্যাশেলেতের সঙ্গে আলোচনা শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী অবস্থায় মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে বলে জানান আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মুশতাক সম্বন্ধে যখন উনি প্রশ্ন করেছেন, আমি পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা তাঁকে পড়ে শুনিয়েছি। তারপর তিনি আর প্রশ্ন করেন নাই।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তিনি দেশের সাংবাদিকদের যে কথাগুলো জানিয়েছিলেন, সেটা মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকেও জানিয়েছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার উদ্বেগ জানিয়েছেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, কোনো উদ্বেগ ছিল না, এটা আলোচনার মধ্যে এসেছে। তিনি জানান, মানবাধিকার সুরক্ষায় দুই পক্ষই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে। এ বিষয়ে মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাঠালে বাংলাদেশের দিক থেকে সেটা বিবেচনা করা হবে।

ধর্মীয় সংহতি পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সঙ্গে আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অতীতে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের কারণে বাংলাদেশ কীভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে, তা তুলে ধরেছেন। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ এবং বিদ্যমান ধর্মীয় সংহতির প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয় বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিক চেষ্টার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

গুমের প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘৭৬টি গুমের যে কথা এসেছে, সেগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুঁজে দেখেছে। তাতে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিচারকাজকে এড়ানোর জন্য তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সেগুলোর নমুনা আমরা তাদের দিয়েছি।’

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নেই: মোমেন

আইনমন্ত্রীর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে। বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগের বিষয়টি নিজে আলোচনায় তুলেছেন উল্লেখ করে এ কে আব্দুল মোমেন পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং তারা বলে নাই, আমরা নিজের থেকে বলেছি। এই রকম বলা হয় যে কিছু লোককে কিল করেছে (বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ রয়েছে) এবং তাদের তথ্য পেলে আমরা নিশ্চয় তদন্ত করে দেখব।’

২০০২-০৩ সালের দিকে ‘হার্টফেল’ করে মানুষ মারা গেলেও এখন সেটা হয় না বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অপারেশন ক্লিন হার্টের কথা বলছেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘হার্টফেল করে মারা যাওয়ার স্টোরি ২০০৩-০৪-০৫ সালের দিকে শুনতাম। এখন শুনি না।’

এ ছাড়া গুম এবং গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়ে বৈঠকে ব্যাখ্যা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের দেশে যেটা হয়, সেটাই আমরা বলেছি। তাদের বলেছি, এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস (গুম) শব্দ আমাদের দেশে নাই। তবে কিছু কিছু লোক বলেছে, ৭৬ জন লোক নাকি গত ১০ বছরে নিখোঁজ হয়েছে। তারা বলেছে যে সরকারই নাকি নিখোঁজ করেছে। ৭৬ জনের ১০ জনকে আবার দেখা গেল, পাওয়া গেছে ঘোরাঘুরি করছে। আর বাকিগুলো এখনো আমরা ঠিক জানি না। এটা তাদের জানিয়েছি।’

বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই—এমন অভিযোগের বিষয়ে জাতিসংঘের কাছে সরকারের অবস্থান তুলে ধরা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কেউ কেউ মনে করে বোধ হয় মিডিয়া নিয়ন্ত্রণাধীন; তাদের বলা হয়েছে, অনেকগুলো নিবন্ধিত মিডিয়া আছে, কিন্তু সরকারের মিডিয়া ছাড়া কোনো মিডিয়াই নাই। আমি বললাম, আমাদের দেশে ২৮০০ মিডিয়া আছে।’

এ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি নতুন পাঠ্যক্রম চালু, দক্ষতা বিকাশের পদক্ষেপসমূহ, ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি চালু, প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষার সুযোগসহ মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে অবহিত করেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।