প্রতীকী ছবি

গ্যাস ও জ্বালানি তেলের পর এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। ইতিমধ্যে ভর্তুকি ছাড়া ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। তবে দাম বাড়ানোর আগে সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ জানতে চায় বিইআরসি। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগে একাধিক চিঠি পাঠিয়েছে তারা।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়ানোর পর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিছুটা সময় নিচ্ছে সরকার। সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ জানা গেলে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হবে।

তবে চলমান লোডশেডিংয়ের মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। তারা বলছে, জ্বালানি সাশ্রয়ে ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করায় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রেও উৎপাদন কমে গেছে। ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রও আগের তুলনায় কম উৎপাদন করছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই।

ভর্তুকি দিয়ে আপাতত বিদ্যুৎ খাতকে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। অর্থ বিভাগ ভর্তুকির পরিমাণ এখনো নিশ্চিত করেনি।
নসরুল হামিদ, প্রতিমন্ত্রী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিইআরসির দুই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে দামের বিষয়ে আদেশ ঘোষণার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। ইতিমধ্যে তিন মাস পেরিয়ে গেছে। তাই ভর্তুকির পরিমাণ জানতে তাগাদা দিয়ে গত বুধবার দ্বিতীয় দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তুকি দিয়ে আপাতত বিদ্যুৎ খাতকে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। অর্থ বিভাগ ভর্তুকির পরিমাণ এখনো নিশ্চিত করেনি।

একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছয়টি বিতরণ কোম্পানিকে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পাইকারি পর্যায়ে গড়ে ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল তারা। এ প্রস্তাব নিয়ে গত ১৮ মে শুনানি করেছে বিইআরসি।

বিইআরসির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, পিডিবির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই চলছে। বিদ্যুৎ বেচে বছরে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে পিডিবির। এর মধ্যে সরকারি ভর্তুকি থেকে বড় অংশ পাওয়ার কথা। বাকিটা দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা হবে। একই সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমায় পিডিবির খরচ কমছে। আবার তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়েছে। পাইকারিতে মূল্যবৃদ্ধির পর ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়াতে কমিশনে আবেদন করবে বিতরণকারী সংস্থাগুলো। তাদের প্রস্তাব নিয়ে শুনানির পর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়বে।

বিইআরসির সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সহনীয় পর্যায়ে দাম বাড়াতে চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদেশ ঘোষণা করা হবে।

গত এক যুগে ৯ বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এ সময়ে পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ দাম বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাম বাড়ানো হয়। ওই সময় সরকারি ভর্তুকি ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরে পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

গত জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ৬ আগস্ট লোডশেডিংয়ের মধ্যে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। ডিজেলে সাড়ে ৪২ ও পেট্রল-অকটেনে ৫১ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পরিবহন, নিত্যপণ্যের বাজার, সব রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনসহ নানা খাতে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে।

পিডিবি বলছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। গত বছরের জুন থেকে ফার্নেস অয়েলে আমদানি শুল্ক চালু হয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে কয়লার ওপর ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে কয়লার দামও বেড়েছে। দেশে গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৫ টাকা ১৭ পয়সা। পিডিবির খরচ হচ্ছে ৯ টাকার বেশি। ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।

দাম না বাড়াতে ক্যাবের চিঠি

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে গত ১৩ জুলাই বিইআরসিতে চিঠি দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব। এতে বলা হয়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির মূল্যবৃদ্ধিতে আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ে ভোক্তা পর্যায়ে লোডশেডিং করা হচ্ছে। আগের বছরের তুলনায় ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কথা থাকলেও এখন উৎপাদন হচ্ছে আগের চেয়ে কম।

এতে জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানির অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। তাই ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এখন আর যৌক্তিক নয়। তাই শুনানি না করে আগের দাম বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে ক্যাব।

ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বদলে ২০ শতাংশ কম উৎপাদন করা হচ্ছে। এ অবস্থায় দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ভোক্তাকে অধিকারবঞ্চিত করে জোরপূর্বক টাকা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে বিইআরসির আদেশ লুণ্ঠনমূলক হবে।