বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি অনিশ্চয়তা: রওনক জাহান

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি কংগ্রেস’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনের আলোচকেরা। আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনেছবি: মীর হোসেন

বাংলাদেশে বর্তমানে গণতান্ত্রিক উত্তরণের যে প্রক্রিয়া চলছে, সেখানে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান। বিষয়টি মানুষের মধ্যে অনেক উদ্বেগ তৈরি করছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে এক আলোচনায় কি-নোট স্পিকার হিসেবে অংশ নিয়ে রওনক জাহান এ কথা বলেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি কংগ্রেস’ শীর্ষক এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে গবেষণা সংস্থা পলিটিক্যাল অ্যান্ড পলিসি সায়েন্স রিসার্চ ফাউন্ডেশন (পিপিএসআরএফ)।

দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিন ছিল আজ। সমাপনী অধিবেশনের আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রথমেই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন অধ্যাপক রওনক জাহান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ হওয়ার পর আমরা অন্তত তিনটি ট্রানজিশন পিরিয়ড (উত্তরণকাল) দেখেছি। এগুলো হলো ১৯৯০, ২০০৮ ও ২০২৪। কিন্তু গণতন্ত্রকে কনসলিডেট (সংহত) করার ক্ষেত্রে আমাদের রেকর্ড অসাধারণ নয়। এমনকি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতারাও অল্প সময়ের মধ্যেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন। এমন নয় যে এটা শুধু গত ১৬ বছরেই ঘটেছে; বরং আমাদের দেশের শুরু থেকেই এটা ঘটেছে।’

বর্তমানে যে গণতান্ত্রিক উত্তরণের আশা করা হচ্ছে, সেখানে অনিশ্চয়তার কারণগুলো উল্লেখ করেন রওনক জাহান। তাঁর মতে, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো ভালোভাবে সংগঠিত নয়। একটি প্রধান দল এ মুহূর্তে বাইরে আছে। ১৬ বছর রাজনৈতিক নিপীড়ন মোকাবিলা করা বিএনপিও সেভাবে সংগঠিত নয়। ফলে গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়াটিতে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা রয়েছে। এটা মানুষের মধ্যে অনেক উদ্বেগও তৈরি করছে।

রাজনৈতিক দলের তহবিল সংগ্রহে স্বচ্ছতা আনা না গেলে দখলদারত্বের রাজনীতি চলতেই থাকবে বলে মনে করেন রওনক জাহান। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর ১১টি সংস্কার কমিশন হয়েছিল। সেখানে রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও রাজনৈতিক দলের সংস্কার নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরও রাজনৈতিক চর্চায় বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। দখলদারত্বের রাজনীতির পরিবর্তন হয়নি, শুধু নতুন দখলদারেরা এই জায়গায় ঢুকেছে।

নির্দিষ্ট কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয় বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষক রওনক জাহান। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে উন্মুক্তভাবে প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত। মধ্য বামপন্থী মানুষদের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে হবে, এটা এখন একটা প্রশ্ন।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি কংগ্রেস’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য দেন অধ্যাপক রওনক জাহান। আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

পরে দর্শকদের প্রশ্নের জবাবে রওনক জাহান বলেন, ‘গত এক বছরে যা দেখা গেছে, পুরোনো চর্চা থেকে আমরা সরে যেতে পারছি না।’ এই পরিবর্তন শুধু একজন নেতার দ্বারা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের খুবই অঙ্গীকারসম্পন্ন একদল নেতা প্রয়োজন, যাঁরা দেশ ও রাজনীতিকে অন্য পথে নিতে পারবে। সেখানে গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজেরও ভূমিকা থাকতে হবে।’

দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথটাকে বন্ধ করা যাবে না উল্লেখ করে রওনক জাহান আরও বলেন, ‘এই পথটা খোলা রাখতে হবে, যাতে প্রতি পাঁচ বছর পরপর মানুষ মুক্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।’

‘এখনো আমরা সেই দাবির মধ্যেই আটকে আছি’

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানও আলোচনায় অংশ নেন। তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘সেই আন্দোলনে স্লোগানগুলোতে ছিল—সামরিক শাসন চাই না, কথা বলার অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, নির্বাচন চাই, গণতন্ত্র চাই। এখনো আমরা ওই দাবির মধ্যেই আটকে আছি।’

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্বের বিভিন্ন আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করেন মতিউর রহমান। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলের সরকারের সময়েই দেশের সংবাদপত্রশিল্প ও প্রথম আলোর ওপর দমন-পীড়ন, মামলা, বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

এ প্রসঙ্গে মতিউর রহমান বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে প্রথম আলোর মালিকানা বদল ও সম্পাদক বদলের চেষ্টার মতো চাপের মধ্যে আমাদের যেতে হয়েছে। জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হয়ে গেল। আমরা বলব, বাংলাদেশের ৫৪ বছরের কোনো আমলে কোনো সময় সেভাবে সত্যিকার অর্থে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আমরা ভোগ করিনি বা পাইনি।’

পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে সংবাদপত্র ও সুশীল সমাজ বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলো সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘সেই ভূমিকাটা এখন দেখতে পাওয়া যায় না। সেটা আমাদের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে একটা বড় দুর্বলতার কারণ বলে আমি মনে করি।’

মতিউর রহমান বলেন, ‘১৯৯১ সালের পর যখন রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় আসা শুরু হলো, তখন থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরিকল্পিতভাবে সুশীল সমাজ ও সংবাদপত্রকে ভাঙতে থাকল দলে নিয়ে, নানা সুবিধা দিয়ে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, রাষ্ট্রীয় সবকিছুর ওপর আধিপত্য তৈরি করা এবং তার পক্ষে থাকার জন্যে সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, এমনকি উপাচার্যরা পর্যন্ত এই ক্রুসেডে যুক্ত হয়েছেন।’ এ প্রসঙ্গে ২০২৪ সালের মার্চে প্রথম আলো বন্ধ ও নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের ডাকা সভায় তৎকালীন উপাচার্যের অংশ নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি।

১০ মাস আগে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে জেয়াফত ও গরু জবাই করা এবং চলতি মাসে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে মতিউর রহমান বলেন, ‘পত্রিকা দুটির কার্যালয় ধ্বংস হয়ে গেল। এ নিয়ে দেশের ভেতরে মানুষের মধ্যে অনেক প্রতিক্রিয়া আছে, আমরা অনেক সমর্থন পেয়েছি, সমবেদনা পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী আমাদের অবস্থাটা কী হলো? এমন একটা দেশ, যেখানে সংবাদপত্র জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, এ দেশটা কি নিরাপদ, এই দেশের মানুষকে কি ভিসা দেওয়া যায়, আমরা কি যেতে পারি, এখানে কি বিনিয়োগ হবে, বিনিয়োগ আসবে—এমন অনেক প্রশ্ন এসে গেছে।’

প্রথম আলোর এজেন্ডা একটাই উল্লেখ করে মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই।’ প্রথম আলো শুরু থেকেই নির্বাচনের পক্ষে সোচ্চার জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু আসলে কি নির্বাচন হবে, হওয়ার মতো পরিবেশ কি থাকছে বা নির্বাচন হলে কি সেটা গ্রহণযোগ্য হবে—এসব প্রশ্ন চলে আসছে। তবে নির্বাচনটা হতেই হবে।

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

‘সবাইকে জাগতে হবে’

আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনীতির ব্যবসায়করণ হয়েছে, ব্যবসায়ীর রাজনীতিকরণ হয়েছে। এর ফলে কোনোটাই সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। রাজনীতির সঙ্গে জাদুর কাঠি যুক্ত। যারাই ক্ষমতায় যায়, তারাই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমাদের সবাইকে জেগে উঠতে হবে। আমরা যদি না জাগি, সকালও হবে না কোনো দিন।’

ঢাকায় নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেনও আলোচনায় অংশ নেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া সফল হোক, সেটি চায় তাঁর দেশ। এ ক্ষেত্রে তাঁদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরওয়ে পর্যবেক্ষক পাঠাবে বলেও জানান তিনি।

নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন। আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

আয়োজনের সমাপনী অধিবেশনে ধন্যবাদ জানান পিপিএসআরএফের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। সমাপনী বক্তব্য দেন সদ্য সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

পরে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এবার সম্মেলনের জন্য জমা পড়া প্রায় ১৬৫টি গবেষণাপত্রের মধ্য থেকে বাছাই করে ৬৭টি প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। অনলাইনে প্রায় ২০টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে অংশ নেন।