বই প্রকাশে কপিরাইট কেন গুরুত্বপূর্ণ

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বই দেখছেন তরুণীরা। এ সময়ই সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশিত হয়ছবি প্রথম আলো

অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলছে। এই মেলার সময়েই বছরের বেশির ভাগ বই প্রকাশিত হয়ে থাকে। প্রায় সব বইয়েই উল্লেখ থাকে স্বত্ব বা কপিরাইট কার, সে কথা। কিন্তু এভাবেই শুধু লিখে দিলেই কি স্বত্ব আইনসম্মত হয়? লেখক ও প্রকাশক উভয়কেই তাঁর মেধাস্বত্বের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে। একটি বইয়ের কপিরাইট কীভাবে অর্জিত হয়, কীভাবে তা বজায় থাকে, তা জানতে ও মানতে হবে। একটি বই লিখে কিংবা প্রকাশ করেই কিন্তু থেমে থাকা উচিত নয়। প্রকাশিত বই হোক বা অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, এটি একটি সম্পত্তি। এটা হচ্ছে মেধার সম্পত্তি। জায়গা–জমির যেমন দখল ও মালিকানা বজায় রাখতে হয়, তেমনি মেধা–সম্পদেরও দখল ও মালিকানা থাকতে হবে। লেখক কিংবা প্রকাশক যিনিই হোন না কেন, প্রত্যেকেরই কপিরাইট নিয়ে কিছু বিষয় মেনে চলা প্রয়োজন।

কপিরাইট কী

মূলত যেকোন সৃজনশীল এবং মৌলিক কাজের ওপর প্রণেতার একচ্ছত্র যে অধিকার, তা–ই হচ্ছে কপিরাইট। দিন দিন কপিরাইট আইনের প্রয়োগ বাড়ছে। জনগণও এ নিয়ে সচেতন ও আগ্রহী হচ্ছেন। মেধাসম্পদের মালিকরাও তাঁদের অধিকার বিষয়ে হচ্ছেন সচেতন। আমাদের দেশে কপিরাইট আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৫) কার্যকর রয়েছে। বর্তমানে নতুন একটি কপিরাইট আইনের খসড়া মন্ত্রীসভায় অনুমোদন পেয়েছে। আশা করা যাচ্ছে যে নতুন এই আইন শিগগিরই পাস হবে। নতুন আইনের খসড়ায় এখানে বেশ কিছু সংজ্ঞা সংযোজন এবং বিয়োজন করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা বা ছদ্মনামে কর্মের স্বত্বাধিকারী, ডেটাবেজ, পাবলিক ডোমেইন, মনোগ্রাম, প্রডিউসার, ব্যক্তি, লোকগান, লোকসংস্কৃতি, সম্পাদক, সম্পত্তি অধিকার—এগুলোর নতুন সংজ্ঞা সংযোজন করা হয়েছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রণেতার ক্ষেত্রে সুরক্ষার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বড়ানো হয়েছে কপিরাইট লঙ্ঘনে জরিমানার পরিমাণ।

বর্তমান কপিরাইট আইন অনুযায়ী সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্পকর্ম, সংগীত, নাট্যকর্ম, শব্দ রেকর্ডিং, সফটওয়্যার প্রভৃতি বিষয়ে কপিরাইট দাবি করা যায়। সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত উভয় ধরনের সফটওয়্যারকর্ম নিবন্ধন করা যায়। কপিরাইট আইন ২০০০–এর বিধানমতে সফটওয়্যারকর্মের কপিরাইটের মেয়াদ যে বছর প্রথম প্রকাশিত হবে, তার পরবর্তী পঞ্জিকাবর্ষের শুরু থেকে ৬০ (ষাট) বছর পর্যন্ত। শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেও প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত উভয় ক্ষেত্রে কপিরাইট নিবন্ধন করা যায়। এ ক্ষেত্রে শিল্পীর জীবনকাল এবং শিল্পীর মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত এর কপিরাইট তাঁর থাকবে। সাহিত্যকর্মের পাণ্ডুলিপি ও বই—দুটোর জন্যই কপিরাইট নিবন্ধন করা যায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে লেখকের জীবনকাল এবং মৃত্যুর পর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট থাকে। নাটকের ক্ষেত্রে প্রণেতা হলেন নাট্যকার কিংবা গ্রন্থাকার।

প্রতীকী ছবি

কপিরাইট নিবন্ধন

কপিরাইট সুরক্ষার জন্য লেখক বা প্রণেতার উচিত তাঁর বইটির কপিরাইট নিবন্ধন করে নেওয়া। বর্তমানে অনলাইনে কপিরাইটের নিবন্ধন করা যায়। এ জন্য ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত কপিরাইট কার্যালয়ে যোযোগ করা যায়। আবেদনপত্রে যে বিষয়টি কপিরাইট করতে চান, তার সব বিবরণ, স্বত্ব কার নামে হবে, শর্ত কী হবে প্রভৃতি বিষয় পূরণ করতে হবে। যে বিষয়ে কপিরাইট নিবন্ধন করার জন্য আবেদন করা হয়েছে, তার ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত ফি ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে জমা দিতে হবে। এর সঙ্গে ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হবে। কপিরাইটের মূল মালিক অন্যকে কোনো বিষয়ে লাইসেন্সও প্রদান করতে পারে। তবে যাঁকে লাইসেন্স দেওয়া হয়, তিনি দখলে থাকেন এবং বিষয়টি বাজারজাত করাসহ বিভিন্ন ক্ষমতা পেয়ে থাকেন। তবে তিনি মূল মালিক হিসেবে স্বীকৃত পাবেন না। কর্মটির প্রণেতাই মূল মালিক হিসেবে থাকেন।

যেকোনো মৌলিক পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে তুলে দেওয়ার আগে লিখিত চুক্তি করে নেওয়া উচিত। এর আগে পাণ্ডুলিপিটিও কপিরাইট করে নিতে পারেন। প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে কপিরাইট আইন মেনে। চুক্তিতে অবশ্যই স্বত্বের অধিকার, মেয়াদ, রয়্যালটির পরিমাণ উল্লেখ থাকতে হবে। চুক্তিনামাটিও কপিরাইট অফিস থেকে নিবন্ধন করে নেওয়ার সুযোগ আছে। কপিরাইট নিবন্ধন করা থাকলে কেউ যদি কপিরাইট ভঙ্গ করে নকল করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার পেতে সুবিধা হয়।

কপিরাইট ভঙ্গ করলে প্রতিকার

কেউ যদি কোনো লেখকের বা প্রণেতার বই বা পাণ্ডুলিপি নকল করেন, তাহলে আইনের চোখে এটি অপরাধ। এ জন্য দেওয়ানি আদালতে সরাসরি প্রতিকার চাওয়া যাবে। জেলা জজ আদালতে ক্ষতিপূরণ, নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য প্রতিকার চাওয়া যাবে। আবার ফৌজদারি মামলারও সুযোগ রয়েছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই নকল বই জব্দ করার ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে। নতুন আইনের খসড়ায় জরিমানা বাড়ানো হচ্ছে।

বইয়ের কপিরাইট নিয়ে মামলা

বই
ফাইল ছবি

বাংলাদেশে জনপ্রিয় ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের কপিরাইট ইস্যু গড়িয়েছিল উচ্চ আদালত পর্যন্ত। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই আবদুল হাকিম ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে স্বত্ব বা মালিকানা দাবি করে সেবা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে শুনানি শেষে ২০২১ সালের ১৪ জুন আদেশ দেয় কপিরাইট অফিস। কপিরাইট অফিস আদেশে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি ও কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়। লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে কপিরাইট অফিসের দেওয়া সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে সেবা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেন হাইকোর্টে রিট করেন। পরবর্তীকালে তাঁর করা রিটটি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।

তানজিম আল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী