ঝকঝকে ভবনের ভেতরে শূন্যতা

রাজধানীর বেইলি রোডে ১৯৪ কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত কমপ্লেক্সটি চালু করা যাচ্ছে না জনবলের অভাবে।

২০১৮ সালে উদ্বোধন করা হয় শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের আওতায় নির্মিত এই প্রশাসনিক ভবন। সম্প্রতি রাজধানীর বেইলি রোড এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাব–লাগোয়া ছয়তলা একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা দেখে যে কারও চোখ আটকে যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রদর্শনের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে নির্মাণ করা হয়েছিল স্থাপনাটি। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের আওতায় নির্মিত এই প্রশাসনিক ভবনটি উদ্বোধন করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভবনটি ঝকঝকে-চকচকে দেখা গেলেও ভেতরে কেবল শূন্যতা। গত ৩ সেপ্টেম্বর সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ভবনটি খালি পড়ে আছে। সাজানো, গোছানো দামি আসবাবে ধুলার আস্তরণ। ভেতরে কোথাও কোথাও শেওলা পড়েছে। সরকারি সম্পদ কীভাবে অযত্ন–অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে, এটি তার একটি উদাহরণ মাত্র।

ভবনের সামনে কথা হলো গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী ফারুক হোসাইনের সঙ্গে। চালু না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ভবন হস্তান্তর করতে কয়েকবার পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ভবনটি চালু হচ্ছে না।

‘শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স’ প্রকল্পের অধীনে প্রশাসনিক ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। তখন এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সমতলের মানুষের পারস্পরিক সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার চর্চা করা। একই সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন মেলা ও উৎসবের আয়োজন করা।

প্রকল্পের আওতায় প্রশাসনিক ভবন ছাড়াও নির্মাণ করা হয় পার্বত্য এলাকার মানুষের ভাড়া থাকার জন্য ছয়তলার একটি ডরমিটরি, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর জন্য দোতলা ভবন, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের জন্য দোতলা ভবন এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনুষ্ঠান দেখানোর জন্য এম্ফিথিয়েটার।

পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। ওই সময়ের মধ্যে প্রশাসনিক ভবনের কাজটি শেষ হয়। অন্যান্য কাজ শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে এ বছর জুন পর্যন্ত করা হয়। আর প্রকল্পের ব্যয় ১২০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯০ কোটি টাকায় নেওয়া হয়। গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।

কমপ্লেক্স চালু হচ্ছে না কেন?

এত টাকা খরচ করে কমপ্লেক্স বানিয়ে তা চালু করতে না পারার কারণ জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, কমপ্লেক্স নির্মাণ ও আসবাব কেনাকাটায় নজর ছিল সবার। কিন্তু নির্মাণের পর কীভাবে তা পরিচালিত হবে; সেদিকে মন্ত্রণালয়ের মনোযোগ ছিল না। প্রথমেই উচিত ছিল জনবল নিয়োগে মনোযোগী হওয়া। তারপর ভবন নির্মাণের দিকে যাওয়া। কিন্তু এখানে হয়েছে ঠিক উল্টো। ২০২০ সালের শেষের দিকে মন্ত্রণালয় থেকে ৭১ জনের একটি জনবলের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা অনুমোদন হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল অনুমোদনের প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ ও জটিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের পর এটি পাঠানো হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। সেখান থেকে অনুমোদন পেলে সচিব কমিটির সভায় অনুমোদনের জন্য তা পাঠাতে হবে। সচিব কমিটির অনুমোদনের পর যাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে কত সময় লাগতে পারে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে তত দিন কমপ্লেক্স ভবনটি অব্যবহৃত অবস্থায় থাকবে।

কমপ্লেক্সের পুরো কাজ করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মিঠুন মিস্ত্রি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জুনের মধ্যে কাজ শেষ করেছি। এরপর বেশ কয়েকবার পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে সবকিছু বুঝে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাইনি।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সচিব হামিদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, জনবল নিয়োগের বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন। কমপ্লেক্সটি এখনো মন্ত্রণালয় বুঝে নেয়নি। তাই সেখানে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম চালু হয়নি। কমপ্লেক্স নির্মাণের আগে কেন জনবল নিয়োগে মন্ত্রণালয় মনোযোগী হলো না, জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের এই কমপ্লেক্স প্রকল্পের পরিচালক হুজুর আলী জানিয়েছেন, ‘যত দিন জনবল নিয়োগ না হয়, তত দিন ভবন দেখাশোনার জন্য বিকল্প উপায়ে জনবল নিয়োগ দেওয়া যায় কি না, তা দেখতে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। ভবনগুলো বুঝে নেওয়ার কথাও বলেছি।’

কমপ্লেক্সটি চালু না হলেও এ বছর জানুয়ারিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম মেলা আয়োজন করা হয় সেখানেই।