মা ও শিশুসন্তানকে নামিয়ে আবার ট্রেনে উঠে পুড়ে অঙ্গার খোকন মিয়া

ট্রেনে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন স্বামী পোশাককর্মী খোকন মিয়া। দুই শিশুসন্তান ও বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে কীভাবে চলবেন, তার কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না স্ত্রী সাজনা আক্তার। আজ দুপুরে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে আহাজারি করছিলেন তিনিছবি: প্রথম আলো

ছোট্ট শারমিনের বয়স আড়াই বছর। মর্গের সামনে কখনো সে আনমনে খেলছিল, আবার কখনো দৌড়ে এসে মায়ের আঁচলের নিচে মুখ লুকাচ্ছিল। মা সাজনা আক্তার যখন বিলাপ করছিলেন, তখন শারমিন কোলে বসে মায়ের মুখের অপলক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। মা কান্না বন্ধ করলে আবার নিজের মতো খেলায় মেতেছিল শিশুটি।

আজ বুধবার বেলা দুইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে গিয়ে এই দৃশ্য দেখা গেল। তখন শারমিনের বাবা মো. খোকন মিয়ার (৩৫) লাশের ময়নাতদন্ত করছিলেন চিকিৎসকেরা। বাবা আর ফিরবে না, তা বোঝার বয়স এখনো হয়নি শিশুটির। মঙ্গলবার ভোরে তেজগাঁও রেলস্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে লাগা আগুনে মারা যাওয়া চারজনের একজন শারমিনের বাবা খোকন। আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে এসে পুড়ে অঙ্গার হওয়া স্বামী খোকনের লাশ শনাক্ত করেন শারমিনের মা সাজনা আক্তার।

স্বজনেরা জানান, খোকন মিয়ার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলায়। বৃদ্ধ মা বকুল আক্তার, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন নারায়ণগঞ্জে। তিনি কাজ করতেন একটি পোশাক কারখানায়। তাঁর স্ত্রী সাজনা আক্তারও একই কারখানায় কাজ করেন। বৃদ্ধ মা ও দুই সন্তানকে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন খোকন। গতকাল ভোরে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে মা ও শিশুসন্তান শারমিনকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জে ফিরছিলেন তিনি। আগুন লাগার পর বৃদ্ধ মা ও শারমিনকে নিরাপদে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনেন খোকন। পরে মালামাল নামানোর জন্য আবারও ট্রেনে ওঠেন তিনি। কিন্তু আর ফেরেননি। খোকন তাঁর আট বছর বয়সী ছেলে আবু তালহাকে কিছুদিনের জন্য গ্রামে মামার বাড়ি রেখে এসেছিলেন।

গতকাল বুধবার সকাল ৯টার দিকে তেজগাঁও রেলস্টেশনে গিয়ে এই প্রতিবেদক খোকনের মা বকুল আক্তারকে ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখেন। খোকনের শিশুসন্তান শারমিন তখন বকুল আক্তারের কোলে ছিল। বকুল আক্তার এই প্রতিবেদককে তখন বলেন, ট্রেনে আগুন লাগার পর খোকন তাঁর শিশুসন্তান শারমিন ও তাঁকে (মা বকুল) ট্রেন থেকে নামান। পরে মালামাল আনার জন্য খোকন আবার ট্রেনে ওঠেন। তখন খোকন তাঁকে (মা) অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। তিনি তখনো (গতকাল সকাল ৯টা) ছেলের অপেক্ষায় স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি মুঠোফোন চালাতে পারেন না বলেও জানান। তাঁর কাছে খোকন বা পরিবারের কোনো সদস্যের মুঠোফোন নম্বরও নেই।

সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার খোকন মিয়া নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় কাজ নিয়ে বৃদ্ধ মা এবং স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে। ট্রেনে আগুনে পুড়ে শেষ হয়েছে তাঁর সেই জীবনসংগ্রাম
ছবি: সংগৃহীত

পুলিশ জানায়, গতকাল পুলিশ ও রেলওয়ে বিভাগের সহায়তায় বকুল আক্তার ও শারমিনকে স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। পরে রাতেই খোকন মিয়ার স্ত্রী সাজনা আক্তার ঢাকা মেডিকেলে এসে দাবি করেন, পুড়ে অঙ্গার হওয়াদের একজন তাঁর স্বামী। যাচাই-বাছাই করে আজ পুলিশ নিশ্চিত হয়, পুড়ে যাওয়া দুজনের একজন খোকনই।

ঢাকা রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেতাফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চেহারা দেখে লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। খোকন মিয়া মা ও সন্তানকে নামিয়ে আবার ট্রেনে উঠে নিখোঁজ হন। তা ছাড়া এই লাশের আর কোনো দাবিদার নেই। এ কারণে অনেকটাই নিশ্চিত লাশটি খোকনের। তবে কেউ যদি এই লাশের দাবি করেন, তাহলে ডিএনএ নমুনার সঙ্গে সেটি মিলিয়ে দেখা হবে।

হতদরিদ্র পরিবারটির এখন কী হবে

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আজ দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, খোকন মিয়ার স্ত্রী সাজনা আক্তার বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সাজনা আক্তার বলেন, খোকন মিয়া সাড়ে চার বছর আগে জীবিকার তাগিদে নারায়ণগঞ্জে এসে পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দেন। তিনি বেতন পেতেন ৯ হাজার টাকা। এই আয়ে সংসার চলছিল না। এ কারণে দুই মাস আগে তিনিও (সাজনা আক্তার) ৮ হাজার টাকা বেতনে স্বামীর সঙ্গে পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন।

সাজনা আক্তার বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, তাঁর সব শেষ হয়ে গেছে। তিনি এবং তাঁর সন্তানেরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।

স্বজনেরা জানান, গ্রামে খোকন মিয়ার কোনো জমিজমা নেই। একসময় অন্যের জমিতে চাষাবাদ করতেন। পরে জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে শহরে আসেন। খোকন মিয়ার বাবা নুর ইসলাম বেঁচে নেই। মা বকুল আক্তার তাঁর সঙ্গেই থাকতেন।