‘লিটল বাংলাদেশ’: লস অ্যাঞ্জেলেসে মাতৃভূমির ছোঁয়া
যুক্তরাষ্ট্রের নান্দনিক শহর লস অ্যাঞ্জেলেস। এখানকার থার্ড স্ট্রিটের নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে আলেকজান্দ্রিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত অংশটুকুতে দাঁড়ালেই মনে হবে, আপনি লস অ্যাঞ্জেলেসে নন, ঢাকার ব্যস্ত কোনো রাস্তায় আছেন। চোখে পড়বে রাস্তার মোড়ে নীল রঙের সাইনবোর্ডে লেখা ‘লিটল বাংলাদেশ’। আর তাই, দূরদেশে থেকেও মাতৃভূমির ছোঁয়া পেতে বাংলাদেশিদের একটি অংশ এ এলাকাকে বসবাসের জন্য বেছে নেন।
হলিউডের আলোঝলমলে নগর থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে অবস্থিত এই ছোট্ট বাংলাদেশ যেন একটুকরা স্বপ্ন। যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের আনন্দ, মাটির ঘ্রাণ ও সংস্কৃতি ফিরে পান।
প্রথম দেখাতেই বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ও দেশীয় সংস্কৃতির উপস্থিতিতে অবাক লাগলেও সত্যি এ ‘লিটল বাংলাদেশ’ গড়ে উঠেছে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বুকে লস অ্যাঞ্জেলেসে। নামটাও দেওয়া হয়েছে সরকারিভাবেই। চারপাশে ছায়া দেওয়া গাছ, দূরে গাড়ির হর্ন ও শহুরে ব্যস্ততা মনে করিয়ে দেয় এখানকার মাটি যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু বাতাসের ঘ্রাণ, দোকানের সাইনবোর্ডের বাংলা নাম, খাবার, দেশি সাজপোশাক, মানুষের আড্ডা ও দোকানপাটের ভিড় বলে দেয়, এখানে রয়েছে ছোট্ট একটুকরা বাংলাদেশ।
শহরের মধ্যে আরেক শহর
থার্ড স্ট্রিট ধরে হাঁটতে শুরু করলে চোখে পড়ে অনেক বাংলাদেশি দোকান। রাস্তার দুই পাশে সরু ফুটপাত, এর পাশে সাজানো মুদিদোকান, বিউটি স্যালন, রেস্তোরাঁ, মোবাইল শোরুম বা মানি অর্ডারের দোকান। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই ভেসে আসে ভাজা সমুচা, পুরি, পেঁয়াজু বা কাবাবের সুবাস। মুহূর্তেই মনে হবে লস অ্যাঞ্জেলেসে নয়, আপনি পুরান ঢাকা বা মিরপুরের কোনো গলিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওই সড়ক ধরে হাঁটার সময় লিটল বাংলাদেশের দোকানগুলো থেকে ভেসে আসে বাংলাদেশিদের কণ্ঠ। কোথাও বাজে রবীন্দ্রসংগীত, কোথাও আধুনিক বাংলা গান। পথচারীর মুখেও শোনা যায় বাংলার টান। দোকানের সামনে জটলা পাকিয়ে দাঁড়ানো তরুণদের আড্ডা, হাতে মুড়ি-চানাচুর বা চা। দোকানগুলোয় ছোট ছোট টেলিভিশন স্ক্রিনে বাংলাদেশি চ্যানেলের খবর চলছে। কেউ মুঠোফোনে ইউটিউবে বাংলাদেশের নাটক দেখছেন, কেউ আড্ডা দিচ্ছেন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। সব মিলিয়ে শহরের ভেতর এক অন্য শহর।
আঞ্জুমান আরা শিউলি বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সম্প্রদায়ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইউনিটি ফেডারেশন অব লস অ্যাঞ্জেলেসের’ সাধারণ সম্পাদক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘লিটল বাংলাদেশ আমাদের কমিউনিটির হৃদয়। এখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা শুধু বসবাস করেন না, তাঁরা নিজেদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক বন্ধনও ধরে রাখেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই, নতুন ও পুরোনো সব প্রজন্ম এই কমিউনিটিতে একসঙ্গে অংশগ্রহণ করুক। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সবাই মাতৃভূমির সঙ্গে সংযুক্ত থাকুক।’
বাংলাদেশি শরীফ হাসান ১৫ বছর ধরে লিটল বাংলাদেশে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমি আগে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এলাকায় থাকতাম। দেশ থেকে আসার পর খুব মন খারাপ হতো। বাংলা খাবার, বাংলা বলা মানুষ খুঁজে পেতাম না। পরে লিটল বাংলাদেশে চলে আসি। এখন আর খারাপ লাগে না। ছুটির দিনে এই বাংলা দোকানগুলোয় খাওয়াদাওয়া করি, আড্ডা দিই।’
আরেক প্রবাসী রুমন মিয়া বলেন, ‘আমি নর্থ হলিউডে থাকলেও বাজার করতে লিটল বাংলাদেশে চলে আসি। “কস্তুরি” বা “দেশি”তে বসে চা খেলে মনে হয় বাংলাদেশের কোনো এলাকার হোটেলে বসে চা পান করছি। লিটল বাংলাদেশে এলে সবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।’
এ এলাকার একটি দোকানে কর্মরত তারেক হাসিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এই দোকানে বছরখানেক ধরে কাজ করছি। এখানে আসে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রবাসী সবাই। ছোট ছোট আড্ডায় সবাই মাতৃভূমির গল্প বলেন, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেন।’
সাইনবোর্ডে আঁকা স্মৃতি
লিটল বাংলাদেশ ও এর আশপাশের বাংলাদেশি দোকানের নামে মাতৃভূমির ছোঁয়া—কস্তুরি, দেশি, সোনার বাংলা, স্বদেশ, আমার বাংলা, বাংলাবাজার, নয়া কিচেন, এশিয়ান মার্ট। নামগুলো দেখলেই মনে হয় যেন বাংলাদেশকে টুকরা টুকরা করে সাজানো হয়েছে। দোকানের ভেতরের সাজানো শেলফ, রঙিন ব্যানার ও লোগো—সব মিলিয়ে মনে হয় ঢাকার কারওয়ান বাজার বা নিউমার্কেটের দৃশ্য।
লিটল বাংলাদেশের রেস্তোরাঁয় শুধু বাংলাদেশি নয়, পাকিস্তানি, ভারতীয় ও নেপালি অভিবাসীরাও আসেন দেশি খাবারের খোঁজে। দুধ–চা খেতে ভিড় করেন মেক্সিকানরাও। সপ্তাহান্তে ভিড় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। কেউ আসেন দুপুর বা রাতের খাবার খেতেও। কেউ কেউ আসেন গরম চা বা মসলাদার বিরিয়ানি খেতে, কেউবা আড্ডা দিতে।
একটু দূরে ভারমন্ট অ্যাভিনিউতে ‘আলাউদ্দিন সুইটস’ নামে একটি মিষ্টির দোকান রয়েছে। সেখানে পাওয়া যায় সবই। কাচের কেসে সারি সারি রসগোল্লা, সন্দেশ ও লালমোহন।
এসব দেশি খাবারের দোকানগুলোয় আসেন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী—সবাই।
লিটল বাংলাদেশের ইতিহাস
লিটল বাংলাদেশের গল্প শুরু হয় ষাটের দশকে। কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে আসেন। ধীরে ধীরে কেউ চাকরি নেন, কেউ ব্যবসা শুরু করেন। আশপাশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামিক সেন্টারের কারণে নতুন অভিবাসীরা একে একে বসতি গড়তে থাকেন।
প্রথমে দোকানপাট ছিল সীমিতসংখ্যক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হতে থাকে মুদিখানা, রেস্তোরাঁ, স্যালনসহ নানা দোকান।
২০১০ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি কাউন্সিল আনুষ্ঠানিকভাবে এলাকাটিকে ‘লিটল বাংলাদেশ’ ঘোষণা করে। তৎকালীন মেয়র অ্যান্টোনিও ভিলারাইগোসা বলেন, ‘এটি শুধু একটি নাম নয়; বরং বাংলাদেশি কমিউনিটির অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যম।’
লিটল বাংলাদেশ তৈরির ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখেছেন কাজী মশহুরুল হুদা। তিনি ছিলেন ‘লিটল বাংলাদেশ ফরমেশনের’ কো-অর্ডিনেটর ও লিটল বাংলাদেশ বিউটিফিকেশন প্রজেক্টের আহ্বায়ক। তিনি প্রথম আলোকে জানান, লিটল বাংলাদেশে কমবেশি ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশির বসবাস। তাঁরা শুধু নিজেদের টিকিয়েই রাখেননি; বরং শহরের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করেছেন।
শিক্ষার্থীদের প্রিয় ‘লিটল বাংলাদেশ’
ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় এক হাজার লস অ্যাঞ্জেলেসে। বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা এ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই থাকেন লিটল বাংলাদেশে। তাঁরা সবাই এখানে কাজ করে লেখাপড়ার খরচ জোগান। কাজ ও পড়াশোনার চাপের মাঝে এক কাপ চা বা গরম ভাত খেতে খেতে রাতে আড্ডা দিতে চলে আসেন বাংলা দোকানগুলোয়।
বাছিত চৌধুরী নামের একজন ছাত্র বলেন, ‘এখানে এলে মনে হয়, ঢাকার কোনো বাজার বা এলাকায় হাঁটছি। দূরদেশে থেকেও আমাদের দেশের স্মৃতি জীবন্ত হয় এখানে এসে।’
ফারজানা রহমান নামের আরেকজন বলেন, ‘আমাদের জন্য লিটল বাংলাদেশ মানে পরিবার, বন্ধু ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মিলনস্থল।’
বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যালিফোর্নিয়ার সভাপতি রাসেল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য শুধু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বা থাকার সুবিধা দেওয়া নয়। আমরা চাই, লস অ্যাঞ্জেলেসে আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা লিটল বাংলাদেশ কমিউনিটিতে অংশগ্রহণ করুক, নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখুক ও বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরুক।’
মসজিদ ও ইসলামিক কেন্দ্র
লিটল বাংলাদেশের প্রাণশক্তির আরেক দিক হলো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এ এলাকার আশপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি মসজিদ। ষাটের দশক থেকেই এসব মসজিদকে ঘিরে বাংলাদেশি মুসলিম অভিবাসীরা বসতি গড়তে শুরু করেন। এখানে শুধু পাঁচ ওয়াক্তের নামাজেই নয়, ঈদের জামাত, ইসলামিক লেকচার ও মিলাদ-মাহফিলেও ভিড় জমে।
মুসলমানদের যেকোনো উৎসবের দিন পুরো এলাকা রঙিন আলোয় ঝলমল করে, যা অনেকটা বাংলাদেশের ঈদগাহের দৃশ্য মনে করিয়ে দেয়। এখানকার মসজিদ কমিটি বাংলাদেশিদের নানাভাবে সাহায্য করে।
স্থানীয় একটি মসজিদের সভাপতি আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিটল বাংলাদেশ এলাকায় আমরা হাউজিং, চাকরি, বিশেষ করে অসহায় বাংলাদেশিদের দাফন-কাফনের কাজে সহায়তা করি। সমাজসেবার কাজই আমাদের অগ্রাধিকার।’
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসব
লিটল বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠন বাংলাদেশি জাতীয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। ঈদের দিন সামনে রেখে চাঁদরাতে মেলা, বাংলাদেশ ডে প্যারেড, বাংলাদেশ মেলা, আনন্দমেলা, লোকসংগীত উৎসব, নজরুল উৎসব, লালন মেলা, বৈশাখী মেলা ছাড়াও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে থাকে নানা আয়োজন। উদ্যাপন করা হয় বনভোজন, ঘুড়ি উৎসবসহ আরও নানা উৎসব।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ ইউনিটি ফেডারেশন অব লস অ্যাঞ্জেলেস, উত্তরণ শিল্পগোষ্ঠী, তরঙ্গ অব ক্যালিফোর্নিয়া, মুসলিম উম্মাহ অন নর্থ আমেরিকাসহ নানা সংগঠন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড আয়োজন করে থাকে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিপার চৌধুরী বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং অন্য ভাষাভাষীদের মধ্যে সাহিত্য ও গান (দেশীয়) ছড়িয়ে দিতে তাঁরা কাজ করছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের বাংলাদেশিদের সহযোগিতায় এবং ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট নর্থরিজের প্রচেষ্টায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সংগীত বিশ্বে প্রচার হচ্ছে। তিনি বলেন, এটি বিরল দৃষ্টান্ত, যা বাংলাদেশ সরকার, বাংলা একাডেমি ও নজরুল ইনস্টিটিউটের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
লিটল বাংলাদেশে পাঁচ ধরনের প্রবাসী বসবাস করেন। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসী পরিবার, নতুন অভিবাসী যাঁরা চাকরি বা ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, ছোট ব্যবসায়ী পরিবার এবং সাংস্কৃতিক ও কমিউনিটি কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া সক্রিয় মানুষেরা।
উত্তরণ সাংস্কৃতিক শিল্পীগোষ্ঠীর প্রধান মোরশেদুল ইসলাম বলেন, লিটল বাংলাদেশ শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি বসতি নয়; এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে দেশি খাবার, পোশাক, সংগীত, সাহিত্য ও অনুষ্ঠান—সবকিছু যেন বাংলাদেশের একটি ছোট সংস্করণ। তিনি বলেন, ‘আমাদের সংগঠন থেকে এখানে বসবাসরত বাংলাদেশি শিশুদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্তি থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়।’