লক্ষ্মীপুরে অসুস্থ মা, ঢাকায় অসুস্থ ছেলেকে বাঁশি বাজিয়ে সঙ্গ দিয়ে চাঙা রাখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারে বন্ধুদের মাঝে অসুস্থ আইমান মাহমুদ। তাঁর ভালো রাখতে বাঁশি বাজাচ্ছেন এক বন্ধু
ছবি: প্রথম আলো

মো. আইমান মাহমুদের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। বিছানায় বসে বাঁশির সুরে ধীরে ধীরে মাথা দোলাচ্ছিলেন। তাঁর পাশেই বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন কামরুল হাসান। এর আগে আইমানের দুপুরের খাবার বেড়ে দেন সাজ্জাদ আহমেদ। তিনি আইমানের সঙ্গে রাতেও ছিলেন। তাঁরা তিন বন্ধু।

গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। আইমান অ্যাজমা ও ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্যসেন হলের ‘বড় ভাই’ ও বন্ধুরা অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি আছেন আইমান। রাতে পালা করে একজন বন্ধু বা হলের বড় ভাই তাঁর সঙ্গে থাকছেন। রাত-দিন বাইরে থেকে ওষুধ কেনাসহ যখন যা লাগছে, তার সবই করছেন এই বন্ধু ও বড় ভাইয়েরাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আইমান। তিনি বলেন, ‘এই বন্ধু এবং হলের বড় ভাইয়েরা না থাকলে আমি কীভাবে টিকে থাকতাম, তা ভাবতেও ভয় লাগছে। অথচ এই মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচয় বা বন্ধুত্ব দেড় মাসের। এই বন্ধুরা জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে সহায়তা করছে।’

লক্ষ্মীপুরের আইমান বলেন, ‘হলে থাকার সময়ই কামরুলের বাঁশির সুর ভালো লাগত। মেডিকেল সেন্টারে মন বা শরীর বেশি খারাপ লাগলে কামরুলকে বাঁশি নিয়ে আসতে বলি। সে আসে। তারপর বাঁশি বাজাতে থাকে। আস্তে আস্তে মন ও শরীর ভালো লাগতে থাকে। আরেক বন্ধু এসে গিটার বাজিয়ে শোনায়। কেউ কেউ আসে শুধু গল্প করতে। বিভাগের মেয়ে বন্ধুরা বাসা থেকে রান্না করে আনে। এই বন্ধুদের একটাই চাওয়া, আমার মন যাতে কোনোভাবেই খারাপ না হয়। এভাবেও অসুস্থ বন্ধুর মন ভালো করা যায়, মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি না হলে তা বুঝতেই পারতাম না।’

আইমানের বাবা রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি মাদ্রাসার কর্মী হিসেবে কাজ করেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে সেভাবে ছেলেকে দেখতে আসতে পারেন না। আইমানের মা রাবেয়া বেগমের ফুসফুসে সমস্যাসহ নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিয়েছে। আইমানের ছোট ভাই দশম শ্রেণিতে পড়ছে। মায়ের সঙ্গে সে লক্ষ্মীপুরে থাকে।

আইমান জানালেন, রক্ত পরীক্ষায় তাঁর ডেঙ্গু নেগেটিভ এসেছে। তবে শরীর খুব দুর্বল বলে একা হাঁটতে পারেন না। তাই তাঁকে একা থাকতে দিচ্ছেন না বন্ধুরা। রুটিন ঠিক করে নিজেরাই মেডিকেল সেন্টারে চলে আসছেন। কেউ ক্লাস শুরুর আগে আসেন। আবার কেউ ক্লাস শেষ করে আসেন। আইমান বুঝতে পারছেন এতে বন্ধুদের ওপরও চাপ পড়ছে।

আইমানের এ কথার প্রতিবাদ করলেন পাশে বসে থাকা কামরুল হাসান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘এখানে আসার জন্য আমাদের তো কেউ বাধ্য করছে না। নিজে থেকেই আমরা আসছি।’

মেডিকেল সেন্টারে বসে বাঁশি বাজানো প্রসঙ্গে কামরুল বলেন, ‘আইমানের সঙ্গে ওয়ার্ডটিতে আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেক সময় তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই বাঁশি বাজাই। রোগীর পাশে বসে বাঁশি বাজাচ্ছি এমন একটি ভিডিও একজন ফেসবুকে শেয়ার দিলে কেউ কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তবে আইমান আমার বাঁশির সুর পছন্দ করে। এতে তার যদি মন একটু ভালো হয়, তাহলে তো তা নিয়ে কারও আপত্তির কিছু নেই।’

আইমানের আরেক বন্ধু সাজ্জাদ আহমেদ পড়ছেন জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষে। তিনিও বলেন, ‘আমি রাতেও আইমানের সঙ্গে ছিলাম। আমরা নিজেরা সুবিধা অনুযায়ী আইমানের সঙ্গে থাকার সময় ঠিক করে নেই। ফলে সমস্যা হচ্ছে না।’

আইমান জানালেন, তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালান। কিছু টাকা জমাতে পেরেছিলেন। তা দিয়েই বর্তমানে চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছেন।

আইমান দৃঢ় গলায় বলেন, ‘আমি কারও কাছে হাত পাততে চাই না। যত দিন পারি নিজের টাকা দিয়েই চিকিৎসা করব। এখানে অনেক ওষুধ কিনতে হচ্ছে। অনেক দিন ধরে টিউশনিতে যেতে পারছি না। টিউশনিটা থাকে কি না, তা নিয়ে একটু চিন্তায় আছি। স্বজনেরা মাঝে মাঝে আমাদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ান।’

জীবনের এ পর্যন্ত আসতে বিভিন্ন সময়ই কিছু ভালো বন্ধু এবং বড় ভাই পেয়েছেন বলে জানালেন আইমান। তিনি বলেন, রাগ করে একবার বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এলাকার বড় ভাই মিরাজ হোসাইন তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহর ঘুরে দেখিয়েছিলেন। সেই বড় ভাইয়ের উপদেশে আবার বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টার
ছবি: প্রথম আলো

মিরাজ হোসাইন তাঁকে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন বলে জানালেন আইমান। বলেন, পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই—তা সেই বড় ভাই তাঁর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। পেছনের সারির শিক্ষার্থী থেকে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছিলেন তিনি। রাজধানীর নটর ডেম কলেজ, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়েছে মিরাজ হোসাইনের জন্য।

পড়াশোনার পাশাপাশি আইমান বিতর্ক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সব সময়। করোনার সময় অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স করেছিলেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ডিজিটাল সোশ্যাল ইনোভেশন ফোরাম (বিডিএসআইফ) ও ডিজিটাল সোশ্যাল ইনোভেশন ফোরাম (ডিএসআইএফ) প্রথমবারের মতো আয়োজন করে ‘গ্লোবাল পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড-২০২১’। তাতে মনোনীত হয়েছিলেন আইমান। তবে দুবাই গিয়ে সে পুরস্কার আনা সম্ভব হয়নি।  

জীবনের সংগ্রাম, সফলতা ও স্বপ্ন নিয়ে নানা কথা বলতে বলতে আইমান আবার ফিরে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর বর্তমান বন্ধুদের কথায়। তিনি বলেন, ‘এই বন্ধুদের জন্য আমি আবার নতুন করে আমাকে খুঁজে পেয়েছি।’