পত্রিকা পড়ার আনন্দ

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনার লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে—নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

মানুষের নানান রকম শখ থাকে। ছবি তোলা, ঘুরে বেড়ানো, মাছ ধরা, আঁকিবুঁকি করা। আমার হলো খবরের কাগজ পড়ার শখ।

যখন ছোট ছিলাম, আমাদের গ্রামের মক্তবের পাশে ছোট একটা ঘর ছিল, ওখানে পত্রিকা আসত। আসত বলতে, ঠিক ওখানে আসত না, তবে পত্রিকাওয়ালা বাজারে রেখে যেত। গ্রাম থেকে যাঁরা বাজারে যেতেন, তাঁদের কেউ মনে করে নিয়ে আসতেন।

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে আমাদের গ্রাম রতন বরিষ। বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত।

আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খেলতে যাওয়ার আগে পত্রিকাটা একবার পড়ে নিতাম। দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহের চেয়ে গল্পের অংশই বেশি ভালো লাগত।

তারপর কলেজে যখন যাই, লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়া যেত। কলেজ থেকে ফেরার পথে টেম্পোর জন্য অপেক্ষা করতে হতো। এই সময়ে মোড়ের এক ফার্মেসি থেকে পত্রিকার দুই-তিনটি পাতা পড়ে নিতাম।

আমাদের বাসস্ট্যান্ডে নেমে দুই-তিন দিন দোকানে গিয়ে পত্রিকা পড়তাম। একটা পত্রিকা পড়লে মনে হতো অনেক কিছুই জানা হলো না।

আমাদের বাসায় পত্রিকা নেওয়া দরকার। এটি আমি অনুভব করলেও পত্রিকা কেনার সাহস ছিল না। টানাটানির সংসারে পত্রিকা কেনা ছিল বিলাসিতা। তাই আমি বাজারের এক ওষুধ বিক্রেতার সঙ্গে একটা চুক্তিতে পৌঁছাই। এক মাসে তাঁর দুই কেজি পেপার জমত। এটি তিনি ৩০ টাকায় বিক্রি করতেন। তাঁর পত্রিকা পড়া শেষ হলে পরের দিন আমি নেব, মানে ১ তারিখের পত্রিকা ২ তারিখে নেব এবং মাস
শেষে তাঁকে ৩০ টাকা দেব। সেই হিসাবে দিনে এক টাকায় আমার পত্রিকা কেনা হয়ে যেত। পত্রিকা পড়ার এই পাগলামির কথা মনে হলে আনন্দ পাই।

এরপর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই, তখন আর পত্রিকা পড়া নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়নি। ক্লাসে গেলে সেমিনার, লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়া যেত। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে স্থানীয় ও জাতীয় সব পত্রিকা থাকত। হলের পত্রিকা কক্ষ তো আছেই। এরপর কিছুদিন গণমাধ্যমে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, তখন তো হালনাগাদ থাকার জন্য পত্রিকা পড়তেই হতো। পড়তে পড়তে প্রথম আলো পত্রিকার লেখাগুলো বেশ ভালো লাগে। শুধু আমার ভালো লাগে বললে একটু ভুল হবে, হলের রিডিংরুমে গিয়ে যদি দেখতাম একজন পাঠকও আছে, তার হাতে প্রথম আলো থাকত।

আমি কিছুদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতেও পড়েছি। ওখানেও একই চিত্র। পাশাপাশি পাঁচ থেকে ছয়টা টেবিলে পত্রিকা থাকত। সবাই আড়চোখে তাকিয়ে দেখত, কখন প্রথম আলোর টেবিল খালি হয়। সিরিয়াল না দিয়ে প্রথম আলো পড়ার সুযোগ কমই হতো।

প্রথম আলো প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের সফলতার গল্প লেখে, প্রথাগত পেশার বাইরেও যে অন্যান্য কাজের মাধ্যমে সম্মানজনক ক্যারিয়ার হতে পারে, সেই গল্প লেখে।

আমাদের একটা সামাজিক উদ্যোগ আছে ‘ফ্রুটস হান্ট’। ফ্রুটস হান্ট নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও মনে মনে ভাবতাম, আমাদের নিয়ে প্রথম আলো কবে লিখবে? অবশেষে ২০২১ সালের ৬ জুন ‘অনলাইনে আম বিক্রি করে রাজশাহীর শিক্ষার্থীদের দিন বদল’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ফোন করে অভিনন্দন জানান। আমরা নিজেরাও অনেক উচ্ছ্বসিত ছিলাম। যে কাগজ পড়ার জন্য পাগল হয়ে থাকতাম, সেই কাগজে আমাদের খবর।

আমরা যখন একেক দিনের প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতা পড়ি, তখন মনে হয় কবি, সাহিত্যিক, গুণী সাংবাদিক, রাজনীতিক, অধ্যাপকদের সামনে বসে তাঁদের অভিমত শুনছি। একজন মানুষের পক্ষে একসঙ্গে এতজন গুণী মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের অভিমত শোনা সম্ভব নয়, যা পত্রিকা পড়ে সম্ভব। খবরের কাগজের প্রতি বিশেষ প্রীতি থাকার কারণ হলো, সমস্যা আর সম্ভাবনা নিয়ে লেখে খবরের কাগজগুলো। গণমাধ্যমে সংবাদ আসার পর কর্তৃপক্ষ সে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয় এবং সমাধানও হয়। আমার মনে হয়, এই সাফল্য যেমন গণমাধ্যম, সাংবাদিক কিংবা সম্পাদকের, ঠিক তেমনি পাঠক কিংবা দর্শকদেরও।

আমার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট বোনের ম্যাগাজিন পড়ার অভ্যাস হয়েছে। প্রথম আলো হাতে নিয়ে সে প্রথমে দেখে বাসার ভাই একটু থামতে বলছে কেন? আদনান মুকিতের লেখা আর আরাফাত করিমের কার্টুন তার বিশেষ পছন্দ। সে এখন দিন গোনে, কবে মাসের ৬ তারিখ আসবে। মাসজুড়ে অপেক্ষা করে কিশোর আলো পড়ার জন্য।

আমরা একটা বিশেষ প্রশিক্ষণে আছি। এখানে সময় বের করা কঠিন। তবু আমরা প্রথম আলো পড়ি। এবার আমার সঙ্গী আমার বন্ধু তমাল কর্মকার। দুজনে মিলে প্রথম আলো কিনি, খবর পড়ি, অভিমত পড়ি, বিশ্লেষণের চেষ্টা করি। কোনো একটা খবর নিয়ে সন্দেহ থাকলে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন, এটা প্রথম আলোয় এসেছে কি না। প্রথম আলো তাদের কাজের মাধ্যমে পাঠকের এই আস্থা ধরে রাখুক।

  • জুয়েল মামুন, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়