কাজে আসেনি ল্যাপটপ–প্রজেক্টর

কোনো বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ নষ্ট, কোনো বিদ্যালয়ে প্রজেক্টর নেই। যেখানে  সব ঠিক আছে, সেখানে প্রশিক্ষিত কোনো শিক্ষক নেই।

কঠিন, দুর্বোধ্য কোনো বিষয়কে ছবি কিংবা ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে আনন্দময় ও সহজবোধ্য করে উপস্থাপনের একটি মাধ্যম ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম’। এ জন্য ঠাকুরগাঁও জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দেওয়া হয় ল্যাপটপ, প্রজেক্টরসহ (বড় পর্দা) বিভিন্ন সরঞ্জাম। কিন্তু বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে এগুলো কোনো কাজে লাগানো যায়নি। কোনো বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, কোনোটিতে চালানোর লোক নেই।

সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলায় মোট ৯৯৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ২০১৫-১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) প্রকল্পের আওতায় জেলার ৫৯৩টি বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, মডেম ও সিম এবং ৩৯৭টি বিদ্যালয়ে পর্দাসহ প্রজেক্টর বিতরণ করা হয়। এসব সরঞ্জাম ব্যবহারে ২৩৯টি বিদ্যালয়ের ১ হাজার ৬১৬ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো কোনো বিদ্যালয় একাধিক ল্যাপটপ পেয়েছে, কোনো বিদ্যালয় ল্যাপটপ পেলেও প্রজেক্টর পায়নি। প্রজেক্টর পেলেও ল্যাপটপ পায়নি, এমন বিদ্যালয়ও আছে।

বিতরণ করা ল্যাপটপ, প্রজেক্টরের মধ্যে কতটি বর্তমানে সচল আছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। দৈবচয়ন ভিত্তিতে সদর উপজেলার ৫৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এসব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৬টি বিদ্যালয় বিতরণের সময়ই অকেজো ল্যাপটপ পেয়েছে। মোটা ৩৯টি বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এ জন্য প্রজেক্টরের মাধ্যমে বড় পর্দায় পাঠদান করা যাচ্ছে না। ১৮টি বিদ্যালয়ে কখনোই বড় পর্দায় ক্লাস নেওয়া হয়নি। ১৮টি বিদ্যালয়ে অনিয়মিতভাবে প্রজেক্টর ব্যবহার করে পাঠদান করা হয়।

শিক্ষকেরা বলছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় যেসব ল্যাপটপ বিতরণ করা হয়েছে, সেগুলোর মান খুব একটা উন্নত নয়। এ কারণে সেগুলো মেরামত করার পরও বারবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

নষ্ট ল্যাপটপ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। এ জন্য এগুলো স্লিপ বরাদ্দ থেকে মেরামত করে নিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম। ল্যাপটপ অকেজোর বিষয়ে তিনি বলেন, দরপত্রের মাধ্যমে ল্যাপটপ কিনে মন্ত্রণালয় থেকে এখানে পাঠানো হয়েছে। তাই মান নিয়ে তাঁদের বলার কিছুই নেই। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেরামতের চুক্তির সময়ও পেরিয়ে গেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বলেন, বড়পর্দায় পাঠ উপস্থাপন করলে শিশুশিক্ষার্থীরা সহজে তা রপ্ত করতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ-প্রজেক্টর দিয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি।

সরেজমিনে যা পাওয়া গেল

গত ২৮ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর এবং ৪ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ওই ৫৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে জানা গেছে, এসব বিদ্যালয়ে ৬৭টি ল্যাপটপ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬২টি ডেল ব্র্যান্ডের, তিনটি এইচপি ব্র্যান্ডের ও দুটি হায়ার ব্র্যান্ডের। ৯টি বিদ্যালয় দুটি করে ল্যাপটপ পেয়েছে। প্রজেক্টর পেয়েছে ৫৩টি বিদ্যালয়। নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা ল্যাপটপগুলোর ২৬টি চালু হয় না, চারটির ডিসপ্লে বা স্ক্রিন নষ্ট, তিনটি করে ল্যাপটপের কি-বোর্ড অকেজো, ব্যাটারি ও সাউন্ডে সমস্যার কথা জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষকেরা।

সদর উপজেলায় মোট ৪০৯টি বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ২৯২টি বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, মডেম ও সিম এবং ২৬৫টি বিদ্যালয়ে পর্দাসহ প্রজেক্টর বিতরণ করা হয়। বড় পর্দায় পাঠদানের জন্য ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর-দুটিই প্রয়োজন। ফলে অন্তত ২৭টি এমন বিদ্যালয় রয়েছে, যারা ল্যাপটপ বা প্রজেক্টরের যেকোনো একটি পেয়েছে।

নষ্ট ল্যাপটপ বিতরণের অভিযোগ

সরেজমিনে খোঁজ নেওয়া ৫৮টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ছয়টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অভিযোগ করেছেন বিতরণের দিন থেকেই তাঁরা নষ্ট ল্যাপটপ পেয়েছেন। বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে কনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাসিয়াদেবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বগুলাডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বলদাপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভোপলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

মালিগাঁও-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি ডেল ল্যাপটপ পেলেও তা এখন সচল নেই। স্লিপ বরাদ্দ থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকা খরচ করেও সেটি ঠিক হয়নি।

কনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হুসনে আরা বলেন, ল্যাপটপটি অকেজো অবস্থায় পাওয়া গেছে। সেটা মেরামতের জন্য বিশেষজ্ঞ দেখালেও ঠিক হয়নি। ল্যাপটপ না থাকায় প্রজেক্টরটিও পড়ে রয়েছে।

নিয়মিত ক্লাস কেবল এক বিদ্যালয়ে

৫৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২১টি বিদ্যালয় এমন পাওয়া গেছে যেখানে ল্যাপটপ পাওয়ার পর দু-একদিন বড়পর্দায় ক্লাস নেওয়া হলেও এখন আর ক্লাস নেওয়া হচ্ছে না। ১৮টি বিদ্যালয়ে অনিয়মিতভাবে বড় পর্দায় ক্লাস নেওয়া হয়। ল্যাপটপ-প্রজেক্টর পাওয়া গেলেও ১৮টি বিদ্যালয়ে কখনোই বড়পর্দায় ক্লাস নেওয়া হয়নি। কেবল একটি বিদ্যালয় পাওয়া গেছে যেখানে প্রতিদিন অন্তত একটি ক্লাস বড়পর্দায় নেওয়া হয়।

মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি ল্যাপটপ দেওয়া হলেও বিদ্যালয়টি প্রজেক্টর পায়নি। ফলে শিক্ষকেরা বড়পর্দায় ক্লাস নিতে পারছেন না। এমন পাঁচটি বিদ্যালয় পাওয়া গেছে যারা ল্যাপটপ পেলেও প্রজেক্টর পায়নি।।

২৮ আগস্ট দুপুরে রুহিয়া-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের দোতলার একটি কক্ষে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস চলছে। সেখানে বড় পর্দায় সৌরজগৎ বিষয়ে পাঠদান করছেন শিক্ষক। বিদ্যালয়টি একটিই ল্যাপটপ পেয়েছে। যেটি সচল। প্রধান শিক্ষক ইয়াসিন আলী বলেন, ‘মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাঠদানে শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠ সহজে রপ্ত হয়। আমরা প্রতিদিন অন্তত একটি শ্রেণির একটি করে পাঠ এভাবে নিই।’

রাখার জায়গা নেই, ল্যাপটপ থাকে বাড়িতে

ল্যাপটপ প্রজেক্টরের মতো দামি সরঞ্জাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখার ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষকেরা। সম্প্রতি বলদাপুকুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাওয়া প্রজেক্টরটি চুরি হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লক্ষ্মীকান্ত অধিকারী বলেন, মাঝেমধ্যে জিনিসপত্র চুরি হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে নষ্ট ল্যাপটপটিও শিক্ষকদের বাড়িতে নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

তথ্য সংগ্রহ করা ৫৮টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৯টি বিদ্যালয়ের ল্যাপটপ শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িতে রাখা হয়। এর মধ্যে ১২টি বিদ্যালয়ের পিয়নেরা ল্যাপটপ তাঁদের বাড়িতে নিয়ে রাখেন। ২৭টি বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ শিক্ষকেরা বাড়িতে রাখেন।

রায়পুর-২ সরকারি প্রাথমিক প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়ার মতো উপযুক্ত কক্ষ নেই। নিরাপত্তার অভাবে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর বাড়িতে রাখা হয়েছে।

শিক্ষক প্রশিক্ষণে অসমতা

২০১৮ সালে একটি ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, পর্দা, মডেম পায় সদর উপজেলার বলদাপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত ২৮ আগস্ট ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা গেছে, মাল্টিমিডিয়ায় পাঠদানের জন্য সরঞ্জাম দেওয়া হলেও কোনো শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাননি। আবার বিতরণের দিন থেকেই ল্যাপটপটি অকেজো।

সরেজমিনে খোঁজ নেওয়া ৫৮টি বিদ্যালয়ের মধ্যে এমন ৯টি বিদ্যালয় পাওয়া গেছে যাদের কোনো শিক্ষকই বড় পর্দায় পাঠদানের বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ পাননি। একজন করে প্রশিক্ষণ পাওয়া বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২টি। ২১টি বিদ্যালয়ের দুজন করে শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। ১২টি বিদ্যালয়ে তিনজন করে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। চারজন করে শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৩টি বিদ্যালয়ে। একটি বিদ্যালয় পাওয়া গেছে যেখানে পাঁচজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার মুনছুর রহমান বলেন, সরবরাহ করা ল্যাপটপ মেরামতে প্রতিটি জেলায় অন্তত একজন করে কম্পিউটার প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থায় বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।