ডিজেলে ব্যয় ফার্নেসের দ্বিগুণ

বেসরকারি খাতের ডিজেলচালিত ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে ফার্নেস তেলে ১০ শতাংশ উৎপাদন বাড়ালেই মাসে সাশ্রয় হবে ৫০০ কোটি টাকা।

দেশে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়। ডলার–সংকটের কারণে সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ে গত জুলাইয়ে সব ডিজেলচালিত কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দেয়। তবে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় আগস্টের মাঝামাঝি আবার বেসরকারি খাতের ডিজেলচালিত ছয়টি কেন্দ্র চালু করা হয়। অথচ এসব কেন্দ্র বন্ধ করে ফার্নেস তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে ব্যয় ৪৮ শতাংশ কমত।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক বিশ্লেষণে এমন তথ্য জানা গেছে। বাড়তি লোকসানের চাপ কমাতে ডিজেল ও ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক এই বিশ্লেষণ করে পিডিবি। এতে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের ডিজেলচালিত ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে ফার্নেস তেলে উৎপাদন ১০ শতাংশ বাড়ালেই প্রতি মাসে সাশ্রয় হবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

পিডিবির দুই কর্মকর্তা বলেন, লোকসান বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কয়েক মাসের বিল বকেয়া পড়েছে। তাই ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সহায়তা করছে না। তারা সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ দিচ্ছে। দেশে সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে ফার্নেস তেলভিত্তিক ৬৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট। আর ডিজেল থেকে উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট।

গত কয়েক দিনের তথ্য বলছে, ডিজেল ও ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে দিনে সর্বোচ্চ ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। তবে অধিকাংশ সময় দিনে গড়ে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে পিডিবির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। তাঁর ফোন নম্বরে খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা বলছেন, আর্থিক চাপে তাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরো সক্ষমতায় চালাতে পারছেন না। ডিজেলের বদলে ফার্নেসে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে দিনে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। কিন্তু আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৪৫ দিন পর বিল দেওয়ার কথা থাকলেও তিন মাসের বেশি বকেয়া পড়েছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান করিম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের চিন্তা তাঁদেরও আছে। কিন্তু আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পারছেন না।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, বেসরকারি খাতের ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা এক হাজার মেগাওয়াট। ৫০ শতাংশ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে মাসে উৎপাদিত হবে ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুৎ। প্রতি লিটার ডিজেল কিনতে খরচ হচ্ছে ১০৫ টাকা ৪৩ পয়সা। প্রতি ইউনিটে জ্বালানি খরচ ২৮ টাকা ধরলে মাসে খরচ দাঁড়ায় ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

অথচ ফার্নেস তেলে উৎপাদন ১০ শতাংশ বাড়ালেই সমান বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। বেসরকারি খাতের মালিকদের এখন প্রতি লিটার ফার্নেস তেল আমদানিতে খরচ পড়ছে ৭০ টাকা। এতে মাসে খরচ কমবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক সংকটে পিডিবি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল দিতে পারছে না। তবে সব ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্রই চালু আছে। ডিজেলের বদলে ফার্নেস থেকে কতটা উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে, তা দেখতে হবে।

দেশে গ্যাস, কয়লা, ফার্নেস, ডিজেল ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি খরচ ডিজেলে এবং সবচেয়ে কম গ্যাসে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ডিজেল থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির খরচ হয়েছে ৩৬ টাকার বেশি। এ সময় ডিজেলের মোট সক্ষমতার প্রায় ১২ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে। ফার্নেস বিদ্যুৎকেন্দ্রে খরচ পড়েছে ১৭ টাকার মতো এবং ব্যবহৃত হয়েছে সক্ষমতার প্রায় ৪২ শতাংশ। কয়লা থেকে উৎপাদনে খরচ ছিল ১৩ টাকার বেশি এবং গ্যাসে সাড়ে তিন টাকার কম। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসচালিত সক্ষমতার ৪৬ শতাংশ ও কয়লার ৩৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে।

পিডিবি সূত্র বলছে, জ্বালানির চড়া দামে বিপুল লোকসানের চাপে পিডিবি। নিয়মিত ভর্তুকিও পাচ্ছে না তারা। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না।

এতে আর্থিক চাপে পড়েছেন ব্যবসায়ীরাও। ডলারের বিনিময় হারে তারতম্যের কারণে বেশি দামে ডলার কিনে তেল আমদানির ঋণপত্র খুললেও পিডিবি বিল দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত বিনিয়ম হারে। তাই লোকসানের কারণে ব্যবসায়ীরা উৎপাদন বাড়াতে রাজি হচ্ছেন না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলনির্ভরতা বেড়ে গেলে পিডিবির টাকার অভাব হবে, এটা অনুমেয় ছিল। বিদ্যুতের দাম বাড়ালে হয়তো তাদের আয় বাড়বে। তবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল নিয়মিত করা উচিত। বিল পরিশোধ করে মাসে ৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করলে পিডিবিরই লাভ হবে।