বাঁধ–স্লুইসগেটের মতো বেষ্টনী পন্থা জনগণকে সংকটে ফেলেছে

পানি ভবনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঢাকা ওয়াসা সেমিনারের আয়োজন করে। পান্থপথ, ঢাকা, ১ জানুয়ারিছবি: পিআইডি

বিদেশি পরামর্শে স্থায়ী বাঁধ, স্লুইসগেট নির্মাণের মতো বেষ্টনী পন্থা দেশের জনগণকে সংকটে ফেলেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বন্যা ঠেকানোর এই পদ্ধতি ক্ষতি আরও বাড়িয়েছে। নদীভাঙন ও জলাবদ্ধতা তীব্র হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বেষ্টনী পন্থার পরিবর্তে উন্মুক্ত পন্থা ব্যবহার করার ওপর জোর দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও জাতিসংঘের সাবেক উন্নয়ন গবেষণাপ্রধান নজরুল ইসলাম।

রাজধানীর পান্থপথে অবস্থিত পানি ভবনে আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঢাকা ওয়াসা আয়োজিত এক সেমিনারে নজরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পানি উন্নয়ন প্রচেষ্টার অভিমুখীনতা সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার তাৎপর্য এবং তা বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট কর্মধারা সম্পর্কিত’ সেমিনারে নজরুল ইসলাম বেষ্টনী পন্থার ক্ষতি ও উন্মুক্ত পন্থা নেওয়ার উপকার তুলে ধরেন।

নজরুল ইসলাম বলেন, বন্যা স্বাভাবিক ঘটনা, যা প্রতিহত করা যাবে না। প্লাবনভূমি নদীর পানি ধারণের স্বাভাবিক এলাকা। সেই প্লাবনভূমিতে বসতি স্থাপন ও নির্মাণকাজ বন্যার প্রকোপ ও ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়িয়ে তোলে। প্লাবনভূমিকে নদীর কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। দেশের পানি উন্নয়ন কার্যক্রম সঠিক ধারায় অগ্রসর হচ্ছে না উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যার সঙ্গে সহাবস্থান করে উন্মুক্ত পন্থা ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

বেষ্টনী পন্থা ব্যবহার না করে উন্মুক্ত পন্থা ব্যবহার করতে হবে বলে উল্লেখ করেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, হঠাৎ করে সব বাঁধ, স্লুইসগেট তুলে নেওয়া যাবে না। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিকৃতি সংশোধন করতে হবে। পরিবর্তন আনার জন্য স্থানীয় সরকার কাঠামোকে গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশে দুর্নীতির সমস্যা আছে, অনেকে ভালো কাজ করতে চায় না, সরকারি অর্থ লোপাট করে দেয়। তবে সমস্যা সমাধানে পরিবর্তন না আনা গেলে টিকে থাকা যাবে না।

কর্মশালায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক রাজনীতিবিদদের জন্য ‘অন্য রকম বাস্তবতার’ সম্মুখীন হওয়ার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্লাবনভূমি, বাঁধ—কোথাও কোথাও এক ইঞ্চি জায়গাও এখন খালি নেই। সব জায়গায় মানুষ বাস করছে। হুট করে কোনো পরিবর্তন আনলে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হতে পারে। একটি রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে এই অবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব নয়।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিপুল পরিমাণে পলিমাটি উজান থেকে ভাটিতে নেমে আসে। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় নদী প্লাবিত হয়ে আশপাশের এলাকা ভেসে যায়, ভাঙন হয়। ওই অবস্থায় জনপ্রতিনিধির কাছে এলাকাবাসী যখন ফোন করে, তখন ব্যবস্থা নিতে হয়। ব্যবস্থা না নিলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, আর ওই সংসদ সদস্যও আর কখনো নির্বাচিত হতে পারবেন না। তিনি নিশ্চিত করেন, ভবিষ্যতে স্লুইসগেট নির্মাণের মতো আর কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষক নজরুল ইসলামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পঞ্চাশের দশকে মূলত বিদেশি পরামর্শে ও অর্থায়নে বাংলাদেশের ওপর বেষ্টনী পন্থা আরোপ হয়। বেষ্টনী পন্থার কারণে একদিকে নদ-নদীর পানি ও পলিপ্রবাহ থেকে প্লাবনভূমি বঞ্চিত হয়েছে এবং প্লাবনভূমিতে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ছোট নদ-নদী, খাল-বিল, দিঘি-পুকুর বিপর্যস্ত হয়েছে। অন্যদিকে নদীতে অধিক পলি পড়ার কারণে নদীর পানি ধারণক্ষমতা বা গভীরতা কমেছে। নদীতীরে ভাঙন বাড়ছে। নদ-নদীর একটির সঙ্গে অপরটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ও নদী সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় দেশে জলাবদ্ধতা বেড়েছে।

সমস্যা সমাধানে বেষ্টনী থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তরণে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এসব বাঁধ হবে অষ্টমাসী অর্থাৎ আট মাস বাঁধ থাকবে আর চার মাস খোলা থাকবে। নদীতীরের ভাঙন রোধে পশ্চিমের কঠিন স্থাপনা (গ্রোয়েন, স্পার, হার্ড পয়েন্ট, কংক্রিট রিভেটমেন্ট ইত্যাদি) নির্ভর পদ্ধতির পরিবর্তে জিও ব্যাগ পদ্ধতি অনেক বেশি কার্যকর ও সুলভ।

কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবহার না হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নদীগুলোকেও রক্ষা করতে হবে। নৌপরিবহন–ব্যবস্থার জন্য ঢাকার ৯টি সেতু ভেঙে নতুন পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, প্রকৃতি যেভাবে চলে, তার বিপরীত ধারায় গিয়ে সফল হওয়া যাবে না। ৭০ বছর ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণের যেসব পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে, তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। এখন বাঁধ নির্মাণ ও স্লুইসগেট নির্মাণের আগে কী অবস্থা ছিল এবং এখন সেটা কী অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। এ কারণে জীবন-জীবিকা, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষতি কতটা হয়েছে, তা নিরূপণ করা দরকার। পাশাপাশি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কতটা উপকৃত হবে দেশ, সেটাও বিশ্লেষণ করতে হবে।

কর্মশালা সঞ্চালনা করেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এস এম শহীদুল ইসলাম।